পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৩
জননী
৭৩

করিয়া চলে। খেলনা ও খাবার দিয়া, তোষামোদের কথা বলিয়া তাহাকে জয় করা যায় না। মামা কত চেষ্টা করিয়াছে, পারে নাই। শ্যামার তিন ছেলেই মামার ভক্ত, বকুল কিন্তু তাহার ধারে কাছেও ঘেঁষে না। শ্যামার সঙ্গেও বকুলের তেমন ভাব নাই, শ্যামাকে সে স্পষ্টই অবহেলা কবে। বাড়িতে সে ভালবাসে শুধু বাবাকে, শীতল যতক্ষণ বাড়ি থাকে পায়ে পায়ে ঘুরিয়া বেড়ায়, শীতলের চুল তোলে, ঘামাচি মারে, মুখে বিড়ি দিয়া দেশলাই ধরাইয়া দেয়, আর অনর্গল কথা বলে। শীতল বাড়ি না থাকিলে ছাদে গিয়া তাহার গোসাঘরে পতুল খেলে, মিস্ত্রিদের কাজ দেখে, আর শ্যামার ফরমাস খাটে। শীতল না থাকিলে মেয়েটার মুখের কথা যেন ফুরাইয়া যায়।

 একদিন শ্যামা নতুন গুড়ের পায়স করিয়াছে, সকলে পরিতোষ করিয়া খাইল, বকুল কিছুতে খাইবে না, কেবলি বলিতে লাগিল, দাঁড়াও, বাবা আসুক, বাবাকে দাও?

 শ্যামা বলিল, সে তো আসবে রাত্তিরে, ওই দ্যাখ্ বড় জাম-বাটিতে তার জন্যে তুলে রেখেছি, এসে খাবে। তোরটা তুই খা।

 বকুল বলিল, বাবা পায়েস খেতে আসবে দুটোর সময়।

 শ্যামা বলিল, কি করে জানলি তুই আসবে?

 বকুল বলিল, আমি বললাম যে আসতে? বাবা বললে দুটোর সময় ঠিক আসবে,— আমি বাবার সঙ্গে খাব।

 শ্যামা বলিল, দেখলে মামা মেয়ের আব্দার? বুড়ো ঢেঁকি মেয়ে বাবাকে পায়েস খাবার নেমন্তন্ন করেছেন, আপিস থেকে তিনি পায়েস খেতে বাড়ি আসবেন।...খা বকু, খেয়ে বাটি খালি করে দে। তিনি যখন আসবেন খাবেন এখন, তুই বরং আদর করে খাইয়ে দিস, এখন নিজে খেয়ে আমায় বেহাই দে তো।

 বকুল কিছুতে খাইবে না, শ্যামারও জিদ চাপিয়া গেল সেও খাওয়াবেই। পিঠে জোরে দুটো চড় মারিয়া কোন ফল হইল না, বকুল একটু কাঁদিল না পর্যন্ত। আরো জোরে মারিলে কি হইত বলা যায় না, কিন্তু যতই হোক শ্যামার তো মায়ের মন, কতবার কত জোরে আর মায়ের মন লইয়া মেয়েকে মারা যায়? এক খাবলা পায়স তুলিয়া শ্যামা মেয়ের মুখে গুঁজিয়া