পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮২
জননী

না? নোট টোট যদি দিয়ে গিয়ে থাকে তা বেরিয়ে পড়বে না? তোকে ধরে তখন যে টানাটানি করবে রে?

 শুনিয়া শ্যামার মুখ পাংশু হইয়া যায়, বলে, কি হবে মামা তবে?

 এবার মামা সুপরামর্শ দেয়, বলে, দে দে, আমায় এনে দে টাকাগুলো, দেখ দিকি কি সর্বনাশ করেছিলি? ওরে নোটের যে নম্বব থাকে, দেখা মাত্র ধরা পড়বে ও টাকা কমলবাবুর! ছি ছি, তোর একেবারে বুদ্ধি নেই শ্যামা, দে নোটগুলো আমি নিয়ে যাই, কলকাতায় মেসে হোটেলে ক’দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকিগে। আস্তে আস্তে পারি তো নোটগুলো বদলে ফেলব, নযত দু’এক বছর এখন লুকানো থাক, পরে একটি দুটি করে বার করলেই হবে।

 সেই রাত্রেই নোটের তাড়া লইয়া মামা চলিয়া গেল। শ্যামা বলিল, মাঝে মাঝে তুমি এলে কি ক্ষতি হবে মামা, পলিস তোমায় সন্দেহ করবে?

 মামা বলিল, আমায় কেন সন্দেহ করবে?—আসব শ্যামা, মাঝে মাঝে আমি আসব।

 রাত্রি প্রভাত হইল, শ্যামার ঘরের ছাদ পিটানোর শব্দে দিনটা মুখর হইয়া রহিল, দুদিন দুরাত্রি গেল পার হইয়া, না আসিল পুলিস, না আসিল মামা, না আসিল শীতল। শ্যামার চোখে জল পূরিয়া আসিতে লাগিল। কতকাল আগে তাহার বার দিনের ছেলেটি মরিয়া গিয়াছিল, তারপর আর তো কোন দিন সে ভয়ঙ্কর দুঃখ পায় নাই, ছোটখাট দুঃখ দুর্দশা যা আসিয়াছে স্মৃতিতে এতটুকু দাগ পর্যন্ত রাখিয়া যায় নাই, সুখ ও আনন্দের মধ্যে কোথায় মিশাইয়া গিয়াছে। জীবনে তাহার গতি ছিল, কোলাহল ছিল, আজ কি স্তব্ধতার মধ্যে সেই গতি রুদ্ধ হইয়া গেল দেখো। শ্যামা বসিয়া বসিয়া ভাবে। বকুল? কোথায় কি অবস্থায় মেয়েটা কি করিতেছে কে জানে। শীতলের সঙ্গে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায় সময়ে হয় তো খাইতে পায় না, নরম বালিশ ছাড়া মেয়ে তাহার মাথায় দিতে পারিত না, কোথায় কি ভাবে পড়িয়া হয়ত এখন সে ঘুমায়, শীতল হয়ত বকে চুপি চুপি অভিমানিনী লুকাইয়া কাঁদে? বিষ্ণুপ্রিয়ার মেয়ের দেখাদেখি বকুলের কত বাবুয়ানি ছিল, ময়লা ফ্রকটি গায়ে দিত না, মুখে সর মাখিত, লাল ফিতা দিয়া তাহার চুল বাঁধিয়া দিতে হইত, আঁচলে এক ফোঁটা অগুরু দিবার জন্য মার পিছনে পিছনে