পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৪
জননী

গেছে তো? শ্যামা জবাবে বলিয়াছে, কি কুক্ষণে যে দোতালায় ঘর তোলা আরম্ভ করেছিলাম দিদি, যেখানে যা ছিল কুড়িয়ে পেতে সব ওতেই ঢেলেছি, কাল কুলি মিস্ত্রির মজুরি দেব কি করে ভগবান জানেন।—বলিয়া সজল চোখে সে নিশ্বাস ফেলিয়াছে। তারপর বিষ্ণুপ্রিয়া খানিক্ষণ ভাবিয়াছে, ভ্রূ কুঁচকাইয়া একটু যেন বিবক্ত এবং রুষ্টও হইয়াছে। শেষে উঠিয়া গিয়া হাতের মুঠায় কি যেন আনিয়া শ্যামার আঁচলে বাঁধিয়া দিয়াছে। কি লজ্জা তখন এ দুটি জননীর: চোখ তুলিয়া কেহ আর কারো মুখের দিকে চাহিতে পারে নাই।

 বেশি কিছু নয়, পঁচিশটা টাকা। বাড়ি গিয়া শ্যামা ভাবিয়াছে, এ টাকা সে লইল কেমন করিয়া? কেন লইল? এখনি এমন কি অভাব তাহার হইয়াছে? ভবিষ্যতে আর কি তাহার সাহায্য দরকার হইবে না যে এখনি মাত্র পঁচিশটা টাকা লইয়া বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিরক্ত করিয়া রাখিল? তারপর শ্যামার মনে পড়িয়াছে টাকাটা সে নিজে চাহে নাই, বিষ্ণুপ্রিয়া যাচিয়া দিয়াছে। নেওয়াটা তবে বোধ হয় দোষের হয় নাই বেশি। বনগাঁয়ে মন্দাকে শ্যামা এক দিন একখানা চিঠি লিখিল, সেই যে রাখাল সাতশ টাকা লইয়াছিল তার জন্য তাগিদ দিয়া। সে যে কত বড় বিপদে পড়িয়াছে এক পাতায় তা লিখিয়া আরেকটা পাতা সে ভরিয়া দিল টাকা পাঠাইবার অনুরোধে। সব না পারুক, কিছু টাকা অন্তত রাখাল যেন ফেরত দেয়।—আমি কি যন্ত্রণায় আছি বুঝতে পারছ তো ঠাকুরঝি ভাই? আমার যখন ছিল তোমাদের দিইছি, এখন তোমরা আমায় না দিলে হাত পাতব কার কাছে? দিন সাতেক পরে মন্দার চিঠি আসিল। অশ্রু সজল এত কথা সে চিঠিতে ছিল যে চাপ দিলে বুঝি ফোঁটা ফোঁটা ঝরিয়া পড়িত। দাদা কোথায় গেল, কেন গেল, শ্যামা কেন আগে লেখে নাই, কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন কেন দেয় নাই, দেশে দেশে খোঁজ করিতে কেন লোক ছুটায় নাই, এমন করিয়া চলিয়া যাওয়ার সময় ছোট বোনটির কথা দাদার কি একবারও মনে পড়িল না? যাই হোক, সামনের রবিবার রাখাল কলিকাতা আসিতেছে, দাদাকে খোঁজ করার যা যা ব্যবস্থা দরকার সেই করিবে, শ্যামার কোন চিন্তা নাই। টাকার কথা মন্দা কিছু লেখে নাই।

 রবিবার সকালে রাখাল ভারি ব্যস্ত সমস্ত অবস্থায় আসিয়া পড়িল,