পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৬
জননী

তাকে যেন দামি পুতুল মনে করিত, এতটুকু আঘাত লাগিলে সে যেন ভাঙ্গিয়া যাইবে এমনি যত্ন ছিল রাখালের। অসুখ হইলে কপালে হাত বুলানোর আর তো কেহ ছিল না তাহার রাখাল ছাড়া।

 টাকার কথাটা দুপুরে উঠিয়া পড়িল। রাখাল মাথা নিচু করিয়া বলিল, জান তো বৌঠান আমার রোজগার? পঁচানব্বই টাকা মাইনে পাই, দুটো সংসার, ছেলেমেয়ে, কোন মাসে খরচ চলে কোন মাসে ধার হয়। একটা বোনের বিয়ে দিয়েছি, এখনো একটা বাকি। তারও বয়স হল দু এক বছরে মধ্যে তার বিয়ে না দিলেও চলবে না। এখন কি করে তোমার টাকা দিই বৌঠান?—তোমার অবস্থা বুঝি আমার অবস্থা বুঝে দেখো।

 সুতরাং তাহাদের কলহ বাধিয়া গেল খানিক পরেই। এমন শীতের দিনে জলে হাত ভিজাইয়া ঠাণ্ডা করিয়া হঠাৎ পরস্পরের গায়ে দিয়া এক দিন যাহারা হাসাহাসি করিত টাকার জন্য তাহাদের কলহ? একি আশ্চর্য কথা যে সেদিনের স্মৃতি তাহারা ভুলিয়া গেল সংসারের রূঢ় বাস্তবতার মধ্যে, যে ইতিহাস স্মরণ করা মাত্র দুদিন আগেও যাহারা অবাস্তব স্বপ্ন দেখিতে পারিত? শ্যামা কড়া কড়া অপমানজনক কথা বলিল সেই সাত শত টাকার উল্লেখ করিয়া রাখালকে সে একবকম জুয়াচোর প্রতিপন্ন করিয়া দিল। রাখাল জবাবে বলিল শ্যামা যদি মনে করিয়া থাকে নিজের হকের ধন ছাড়া শীতলের কাছে কোন দিন সে একটি পয়সা নিয়াছে শীতল জেল হইতে ফিরিলে শ্যামা যেন আর একবার তাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখে। শ্যামা বলিল, হকের ধন কিসে? রাখাল বলিল শ্যামা তার কি জানিবে? মন্দার বিবাহ দিবার সময় শীতল যে জুয়াচুরি করিয়াছিল রাখাল বলিয়াই সেদিন তাহার জাত বাঁচাইয়াছিল আর কেহ হইলে বিবাহসভা হইতে উঠিয়া যাইত: শীতল অর্ধেক গয়না দেয় নাই, পণের টাকা দেয় নাই একটি পয়সা। তারপর সেই গোড়ার দিকে প্রেসের কি সব কিনিবার জন্য ভুলাইয়া সে যে রাখালের পাঁচশত টাকা লইয়া এক পয়সা কোনদিন ফেরত দেয় নাই শ্যামা কি তা জানে? সংসারে কে কেমন লোক জানিতে রাখালের আর বাকি নাই।

 এই সব কথার আদান প্রদান করিবার পর দুজনে বড় বিষণ্ণ হইয়া রহিল। রাখাল বিদায় হইল বিকালে।