পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পূর্ণিমা একটু বিদ্রূপের সুরে বললে—'দিদির চেয়ে বড় নিশ্চয়ই—কিন্তু তোমার চেয়ে ছোট ঢের।'
সন্তোষ একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বললে, 'আমার চেয়ে ঢের ছোট আর কী করে হয়—বম্বেতে তো কয়েক বছর ধরেই আছেন—ইণ্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসে নতুন লোক শিগগির নেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না।'
সন্তোষ একটু নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে বললে, 'হয় তো ছোটই হবে আমার থেকে।' একটু পরে মাথা তুলে একটু মৃদু রহস্য করে সন্তোষ বললে, ‘তিন বোনের ভেতর সবচেয়ে রূপসী সতেজ মানুষটিই গেল এক বুড়ো অকর্মণ্যের হাতে; জীবনের বিচার, বিবেক, পুরস্কারের এই রকম উপলব্ধি নিয়ে সৃষ্টিটা কোনদিকে যাবে? টিকবেও-বা কত দিন? টিকলেও এর সার্থকতাই-বা কী?'
এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর সন্তোষের নিজের কাছেই ছিল। পৃথিবীতে সে আনন্দ উৎসব সম্ভোগ করতে আসে নি, এসেছে সহ্য করতে, জীবনের তামাশাটা বুঝে নিতে। কিন্তু পূর্ণিমাকে সেই রকম গোপন, নিশ্চয় জীবনের ভিতর জীবিত করে নেবার না আছে কোনো অধিকার সন্তোষের, না আছে কোনো সাহস; রুচি নেই—প্রয়োজন নেই।
পূর্ণিমা দু-এক মিনিট মাথা হেঁট করে চুপ করে রইল।
আস্তে-আস্তে মুখ তুলে বললে –‘রঙ্গ করতেই শিখে এসেছিলে শুধু—এই জন্যই তোমার কিছু হল না। পুরুষ মানুষের যা কর্তব্য তা করতে পারো না? নিজেকে কেন এতটা হীন করে ফেলতে চাও?'
কিন্তু পূর্ণিমা নিজের বিবাহিত জীবনের সঙ্গে গভীর সংলগ্ন একটা দুঃখকে চাপবার জন্যই বড়-বড় সাহসের কথাগুলো পেড়ে যাচ্ছে শুধু। দুবৃত্ত জীবন যা মেয়েমানুষকে, রূপকে, রসকে, আগ্রহ আন্তরিকতা যত্ন প্রয়াসকে, কুটোর চেয়েও নগণ্য মনে করে—সেই জীবনেরই একটি পরম কৃপার পাত্র হয়ে বেঁচে থেকে ও পূর্ণিমা তাকেই চোখ রাঙিয়ে শাসন করতে চাচ্ছে। প্রবল, দুর্দান্ত জীবন তামাশা বোধ করে, গোপনে হেসে চলেছে যে, পূর্ণিমা যদি কোনোদিন তা দেখত!

পূর্ণিমা একটু আশ্বস্ত হয়ে বললে –'বাপ-মা নেই আমাদের—আমরা অকুলে ভাসছিলাম। ভেবেই পেতাম না দিদির কী হবে, ওর যে এমন সুন্দর একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল এতে আমাদের সকলেরই মঙ্গল হবে।'

১৫৬