পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দেবেন্দ্রনাথের চোখে ইনি পড়েন। সুপুরুষ, শিক্ষিত, নদীয়া জেলার ব্রাহ্মণ জমিদারের পুত্র অথচ কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত উমেশ গ‌ুপ্তের সঙ্গগ‌ুণে অনেক পুরানো সংস্কার ছিন্ন করা এই ছেলেটিকে দেখে জামাই করার প্রবল ইচ্ছা হয় দাদামশায়ের। বড় মাসিমা সৌদামিনী দেবীর বিবাহ অনেককাল আগে সনাতনী রীতিতেই হয়ে গেছে, কিন্ত‌ু মেজ মাসিমা সুকুমারী দেবীর সময় থেকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা দিয়ে জামাইদের বিবাহমন্ত্র উচ্চারণ করান হত, এবং পূর্বাপর প্রথামত কন্যাসহ জামাইরা শ্বশ‌ুরগৃহেই স্থায়ী বাসিন্দা হতেন। আমার পিতা এই দুটি রীতিই মানতে অস্বীকৃত হলেন। দৃপ্তপুরুষ তিনি বল্লেন ব্রাহ্মধর্ম ও হিন্দুধর্মে মূলগত কোন ভেদ নেই, নিরাকার বা সাকার ব্রহ্মের উপাসক-দুইই হিন্দু। সুতরাং আলাদা করে ব্রহ্মোপাসক বলে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেওয়া অনাবশ্যক। দ্বিতীয়ত বিবাহের পর তিনি পত্নীকে স্বগৃহে নিয়ে যাবেন, শ্বশ‌ুরগৃহে থাকবেন না। দাদামহাশয় তাঁর এই দুই সর্তই মেনে নিলেন। যদিও মা তাঁর পরম আদরের মেয়ে ছিলেন তবু তাঁকে আলাদা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সম্মতি দিলেন। এদিকে আমার পিতৃদেব মহর্ষির কন্যাকে বিবাহ করায় তাঁর পিতা-কর্তৃক ত্যাজ্য হলেন। সে এক বিষম সমস্যা— পিতাপুত্র দুইজনে সমান জিন্দি, সমান ক্রোধালু। তাঁদের দেশে “ঘোষালে রাগ” বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিল। যেমন বীরপুরুষ তাঁরা ডাকাতদের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধ করতেন, তেমনি আপোষের রাগারাগিও সহজে মিটত না।

 আমার পিতার জ্যৈষ্ঠভ্রাতা থাকায় কনিষ্ঠ তাঁকে তাঁর প্রভূত সম্পত্তিশালী জ্যেষ্ঠতাতের দত্তক করে দেওয়া হয়। কিন্ত‌ু বালক জানকীনাথ ছমাসের বেশি সেখানে রইলেন না। দত্তকপুত্র হওয়া অপমানজনক জ্ঞান করে একদিন কাউকে না বলে কয়ে সে গ্রাম থেকে পালিয়ে হেটে নিজেদের বাড়ি ফিরে এলেন। সেখানকার উত্তরাধিকার হারালেন। তাঁর দাদার অনপেক্ষিত হঠাৎ মৃত্যুতে জানকীনাথই পিতা জয়চন্দ্র ঘোষালের একমাত্র উত্তরাধিকারী হলেন। কিন্ত‌ু পিরালী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যাকে বিবাহ করে সে অধিকারও খোয়ালেন। আমার পিতামহ ক্রোধে ক্ষোভে জর্জরিত হয়ে দুহাতে তাঁর জমিদারী বিষয়সম্পত্তি নষ্ট করতে লাগলেন। যেন কপর্দকও ছেলের হাতে না পড়ে।

 এই দুর্জয় ক্রোধ কালক্রমে কিরকমে শমিত হল, পিতাপত্রে বিসম্বাদ যে কেমন করে মিটে গেল আমরা ছোটরা কিছুই জানি না। আমরা যখন