পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আহার্যের বন্দোবস্তর জন্যে রেস্তরাঁর রন্ধনশালায় গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন। শুনলেন, সেদিন যা কিছু রান্না হয়েছিল, সব শেষ হয়ে গেছে—এত বেলায় আর কিছু পাবার যো নেই একটু শুকনো পাউরুটি ছাড়া। এই সময় দুজন ‘boy’ বা খানসামা এল—পরস্পরের সঙ্গে বাঙলায় কথা কইছে। আমি তাদের বাঙলায় জিজ্ঞেস করলুম—“তোমাদের বাড়ি কোথায়? বাঙলা দেশে?” তারা বিস্মিত হয়ে বললে—“হ্যাঁ, ঢাকায়। আপনিও কি বাঙালী? এত দেরি করে এসেছেন—সব ত ফুরিয়ে গেছে। আচ্ছা, তবু দেখি কি করতে পারি।” ঘণ্টাখানেক বসতে হল, কিন্তু তার মধ্যে দাল ভাত মাছ তরকারি সব সুচারুরূপে রান্না হয়ে টেবিলে হাজির। বাঙালী খানসামার বাঙালীত্ব সেদিন আমার আতিথ্যসৎকারে পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করলে। যখন দাম দিতে গেলুম, মনমরা হয়ে গ্রহণ করলে—রেলওয়ে কোম্পানী নয়ত তার উপর নারাজ হতে পারে, জরিমানা করতে পারে—আমি এই ভয়ের ছবি দেখানতে নিলে।

 সুজাতালিদের অনেকটা ইংরেজী রকম রওয়া সওয়া হলেও মেয়েদের পোশাকে-পরিচ্ছদে আচার-ব্যবহারে একটা নিজস্বতা আমায় আকৃষ্ট করেছিল—যেমন অনেক বছর পরে বম্বের তায়েবজী পরিবারেও তাই দেখেশুনে আকৃষ্ট হই। মহীশূরের হিন্দুজগৎ আমার পক্ষে একটি অভিনব জগৎ, অতীতের জগৎ, কাব্য ও চিত্রের জগৎ—আমি তার মুগ্ধ দর্শক মাত্র, মানবিকতায় তার অঙ্গীভূত নই। এখানে এক পার্শি ও এক মুসলমান গৃহের গৃহীদের সঙ্গেই আমার আধুনিকতা ও মানবিকতার জীবন্ত সংযোগ হল। দেখলুম যে, ধর্মের প্রভেদে মানুষে মানুষে মিলের কিছু আসে যায় না—মনের মানুষ তারাই হয় যাদের মনের সঙ্গে মন মেলে, ধর্মের ধ্বজা সেখানে আপনাকে খাড়া করে মানুষকে ধমক দেয় না।

 মহীশূর প্রবাসে দু-চার মাস পরে সেখানে দৃষ্ট অতীতের নূতনত্ব ও মোহ যত কমে আসতে লাগল, ততই একটু একটু মন কেমন করতে আরম্ভ করল নিজের বর্তমানের জন্যে, নিজের পারিবারিক আবেষ্টনের জন্যে, পারিপার্শ্বিকের জীবন্ততার জন্যে। এখানে ১লা বৈশাখের দিন কলকাতায় নববর্ষের উৎসবের কথা মনে পড়ে, ভ্রাতৃ-দ্বিতীয়ায় নিজেদের বাড়িতে ভাইবোনের মিলনের কথা মনে পড়ে। ‘নৌরাত্রে’ বাঙলা দেশে দুর্গাপূজার ধুমধাম ও ভাসানের ঘটা মনে পড়ে। খুসী—মিসেস ডি এন রায়—কেন যে স্বামীর সঙ্গে প্রথম প্রথম বম্বে গিয়ে তাঁর প্র্যাক্‌টিস সেখানে খুব জমে উঠলেও, বাঁধা আয় ও আয়েস ছেড়ে কলকাতায়

১২২