পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একটু একটু বড় হচ্ছি আমাদের স্নেহালু পিতামহের মধ্যে মধ্যে আমাদের গৃহে শুভাগমনে আমরা নানা রকমের আনন্দ-রসাস্বাদী হতে লাগলাম শুধু জানি।

 বিয়ের পর মা-রা আলাদা বাড়িতে গিয়ে থাকায় আমার প্রায় পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত যোড়াসাঁকোর বাইরেই আমরা ভাইবোনেরা মানুষ হতে লাগলাম। কিন্তু যোড়াসাঁকোর সঙ্গে মাদের সংস্রব পূরোমাত্রাই রইল। এমন একটি দিন যেত না যেদিন হয় মা-বাবা যোড়াসাঁকোয় না যেতেন, কিম্বা যোড়াসাঁকোর লোকেরা আমাদের বাড়ি না আসতেন।

 ছমাস বয়সে খুব ঘটা করে আমার অন্নপ্রাশন হল পেনেটির (পানিহাটির) বাগানবাড়িতে। গঙ্গাধারের সে বাগানবাড়ি তখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই সম্পত্তি। সেবার যোড়াসাঁকোর বাড়িশুদ্ধ সকলের সেটা গ্রীষ্মনিবাস হয়। সে বাড়ির বতর্মান স্বত্বাধিকারী মৈমনসিং সেরপুরের জমিদার গোপালদাস চৌধুরী মহাশয়। তিনি ওটি একটি ট্রাস্টের হাতে সমর্পণ করে ওখানে নিজের মাতার নামে “গোবিন্দমোহিনী ভবন” বলে একটি অনাথাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন। কয়েক বৎসর পূর্বে তার দ্বারোদ্ঘাটন উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রিত হয়ে মাতুল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমি এখানে আসি। নিজের স্মৃতিবহির্ভূত অন্নপ্রাশনের অর্ধশতাব্দীরও পরে এই প্রথম আমি জ্ঞানগোচরে আবার এ বাগানে এলুম। কি চমৎকার গঙ্গাধারের বাড়িখানি! কি সুন্দর ঘাট! ঘাটের উপরেই নহবৎখানা। কল্পনায় ছমাসের শিশু আমার লালচেলি পরা কপালে চন্দন মাখা চেহারা চোখে জাগল, কল্পনায় সেদিনকার সানাইয়ের বাঁশীর রব কানে শুনতে পেলাম। কিন্তু মাতুল রবীন্দ্রনাথের কল্পনাগত নয়, স্মৃতিগত ব্যাপার। আজ তাঁর হাত দিয়ে উদ্যোক্তারা যে বাড়ির একপ্রান্তে একটি আবক্ষ রোপণ করালেন সেই মনোরম গঙ্গাধারের বাড়িতে তাঁর একাদশবর্ষীয় নিজের জীবনের বহু স্মৃতি উদ্বেল হয়ে উঠতে লাগল। কোথায় পড়ে রইল আজকের মেয়েদের আয়োজন, তাদের পড়া মানপত্র, আর তার বাঁধাগতের উত্তর তাঁর! সেই বাগানবাড়ির এক একটা ঘরে বা বাগানের এক একটা দিকে উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে বালক নিজেকে যত খুঁজে পেতে থাকলেন সেদিনের ছমাসের যে শিশু-আত্মীয়া আজ পাকাচুল নিয়ে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে—তাঁর মনে ভরে ওঠা সেদিনের সব কথার একমাত্র দরদী শ্রোতা সেই হল।