পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জাতীয়তার পতাকাধারী বলে দেখত, কর্মবাদীরা তাঁকে কর্মের প্রচণ্ড উত্তেজক বলে জানত। তাঁর শিষ্যেরাই কেউ কেউ বলতেন—“পরমহংসদেবের আমলে বেশ ছিলুম। ভগবানের ধ্যানে ভোঁ হয়ে থাকতুম, কোন বালাই ছিল না। স্বামীজীর কি হল—আমেরিকা থেকে ফিরে এসে খালি বলেন—কাজ, কাজ, কাজ—সেবা, সেবা, সেবা। একদণ্ড স্থির হয়ে বসার যো নেই, মহাবিপদেই পড়া গেছে।”

 প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই ভূখণ্ডের লোকের মধ্যে গভীরভাবে প্রবেশ করে দেখেছিলেন—যে সত্ত্ব রজ ও তম তিনটি গুণের মিশ্রণ এক একটি মানুষ—তাদের প্রত্যেকটির পরিমাণের তারতম্য আছে প্রতি মানুষে এবং সেই তারতম্য-ভেদে একটা দেশের মানুষদের বা একটা জাতির জাতীয় গুণের ভেদ হয়। ভারতবাসী আপাততঃ বহু পুরুষানুক্রমে স্তূপীকৃত তামসিকতার তলায় প্রোথিত হয়ে আছে। সেই স্তূপ ভেঙ্গে ভেঙ্গে, সরিয়ে সরিয়ে, রাজসিকতা ধরে ধাপে ধাপে উঠলেই তবে আবার আধ্যাত্মিকতার চরম শিখরে আরূঢ় হবে, এখন সেখান থেকে স্খলিত হয়ে আছে—এই তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল। তাই তিনি গীতার কর্মযোগের উপদেশ শিষ্যদের মধ্যে প্রচার করলেন এবং সাবেক গুরুভাইদের মধ্যেও প্রতিষ্ঠিত করলেন। গুরু রামকৃষ্ণদেবের নামে উন্মুক্ত মিশনের ধর্ম হল আর্তের, দঃস্থের, বিপন্নের সেবাকার্য ও অতিথি সৎকার, শুধু ভগবদ্‌ধ্যানে ভোঁ হয়ে থাকা আর কলকে টানা নয়। আজ ভারতে বা ভারতের বাইরে যেখানে যেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের পতাকা উড়ছে, সেখানে সেখানেই দরিদ্রনারায়ণের সেবা বিশেষভাবে পরিদৃশ্যমান হচ্ছে। ভারতের সামাজিক বা রাজনৈতিক সংস্কাররূপ বিপ্লব-প্রবর্তক ও দ্বন্দ্বমূলক কর্ম তাঁদের প্রোগ্রামে নেই। মহাত্মা গান্ধী স্পষ্টাস্পষ্টি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্মশীল, সুতরাং বিপ্লবমুখী দ্বন্দ্বপরায়ণ কর্ম তাঁর। কিন্তু সে দ্বন্দ্বের বিষদাঁত ভেঙ্গে ফেলেছেন দ্বন্দ্বটাকে ‘নিরস্ত্র’ করে। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মত সেবা করেন, বিপ্লবের পাশ দিয়ে যান না। বরঞ্চ বিপ্লবের কাজে ধরা পড়া ও ছাড়া পাওয়া অনেক যুবকদের মিশনের ক্রোড়ে স্থান দিয়ে তাদের ক্ষতবিক্ষত জীবনকে শান্তির পথে নিয়ে যান। ভারতের জাতীয়তা বিবেকানন্দের শিষ্যদের প্রাণের মর্মমূলে বিরাজ করছে, কিন্তু সে জাতীয়তা বাহু প্রসার করে সর্বমানবিকতায় বিস্তৃত, সকল জাতির নরনারীকে তাঁদের জাতীয় কৃষ্টির অন্নে পুষ্ট করতে প্রস্তুত। সেই কৃষ্টির বীজ বোধ হয় আমার ভিতর লক্ষ্য করে-

১৬৩