পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ছিলেন, তাই স্বামীজী নিবেদিতাকে বলেছিলেন, “সরলার education prefect”। আমার রচনায় যে আত্ম-অভিব্যক্তি পেয়েছিলেন, সে ভারতীয় আত্মা—ইংলণ্ডীয় নয়, ফরাসীয় নয়। ভারতীয় সভ্যতার বীজ তাতে নিহিত দেখেছিলেন। তাই ‘ভারতী’তে তাঁর সম্বন্ধে আমার প্রথম লেখাটি পড়েই তাঁর কল্পনার চোখে সে বীজের ভিতর অঙ্কুরিত ও পল্লবিত বৃক্ষকে দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তখনই তাঁর একান্ত উৎসাহ জাগ্রত হয়ে উঠেছিল এই রকম ভারতীয় নারী, ভারতীয় বেশে বিদেশে গিয়ে ভারতীয় শিক্ষা প্রচার করুক। পরে আমাকে সাক্ষাতে দেখে শুনে, আমার কথায়-বার্তায়, আমার লেখা গদ্যে পদ্যে সেই ভাব স্থায়ী হয়ে তাঁকে পেয়ে বসেছিল, আমাকে তাঁর সঙ্গে প্রচারকার্যে বিদেশে নিয়ে যাবার জন্যে আগ্রহযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর আগ্রহের প্রাবল্যে আমার অপ্রস্তুততার মাত্রার প্রতি দৃষ্টি দেননি বোধ হয়। নিবেদিতা একেবারে আনকোরা পাশ্চাত্য মেয়ে ছিলেন, ভারতীয় ধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষা-দীক্ষা তাঁর একেবারেই ছিল না, তাঁকে যদি গড়ে তুলতে পেরে থাকেন তবে আমাকে প্রয়োজন মত গড়ে পিটে নেওয়া খুবই সহজসাধ্য এইটে অনুমান করেছিলেন বোধ হয়। নিবেদিতাকে যদি “কালীতত্ত্ব” বুঝিয়ে তাঁকে দিয়ে এলবার্ট হলে কালী সম্বন্ধে বক্তৃতা দেওয়ান সম্ভবপর হয়ে থাকে, তবে আমাকে বোঝান আরও সহজ হবার কথা। নিবেদিতার বক্তৃতা শুনে সায়ান্স এসোসিয়েশনের ডাক্তার মহেন্দ্র সরকার ভীত হয়ে বলেছিলেন —“এতদিন কালো কালী ছিল—তাই রক্ষে, এ সাদা কালী এসে দাঁড়ালে দেশকে পৌত্তলিকতা থেকে আর বাঁচান যাবে না।’’ স্বামী বিবেকানন্দ জানতেন, আমি মহর্ষির দৌহিত্রী বটে, ব্রাহ্মভাবে মানুষ বটে, কালীদুর্গার বিদ্বেষপুষ্ট ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব আমার উপর খুব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বটে, এ সবই সত্য। কিন্তু তা হলেই বা? নরেন দত্তরূপে তিনি যখন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্রের অনুগামী ছিলেন, তিনিও কি তখন ব্রাহ্মভাবাপন্ন ছিলেন না? পরমহংসদেবের সংস্পর্শে এসে সাকার-নিরাকারভেদের পর্দা তাঁর জ্ঞানচক্ষু থেকে আস্তে আস্তে সরে যায় নি কি? আমারও যেতে বাধ্য। এই নিশ্চয়তায় প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি আমায় তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক হয়েছিলেন। এদিকে আমার এ বিষয়ে যে ততটা উৎসাহ হল না তার কারণ কতকগুলি চিরাগত তামসিক সংস্কারের বশে ও তার দরুন ভীরুতায়।

 বিবেকানন্দ দেহরক্ষা করলেন। দেশ শোকসন্তপ্ত হল, কিন্তু দেশের

১৬৪