দেওয়াটা পুনঃ পুনঃ নানাভাবে চালাতে থাকল। ঘাতের প্রতিঘাতও চলল। এই বিদেশীয়দের সঙ্গে দেশস্থদের পূর্ববৎ “রুটি ও বেটি ব্যবহার’’ অসম্ভব হল। আর একটা ব্যাপার দেখা দিলে। বিদেশীরা ভারতের প্রতি প্রান্তে প্রান্তিক ভারতীয় ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হলেও, তাদের ছেলেমেয়ের মাতৃভাষা ভারতীয় হয়ে গেলেও—পঞ্জাবে পাঞ্জাবী, গুজরাটে গুজরাটী, মাদ্রাজে তামিলতেলেগুমলয়ালম্, ইউ-পিতে খিচুড়ি হিন্দী এবং বঙ্গদেশে বাঙলা—ছেলেদের নামকরণ আরবী, ফার্সি ভাষাতেই হতে থাকল। মুল্লাদের কৃপায় মাথা ন্যাড়া বৌদ্ধ, বাগদী, ডোম, মেথর, মুচি বা অন্যান্য ইতর জাতির বাঙ্গালীরাও নামের গৌরবে যেন আরব পারস্য বা তুরস্ক দেশ থেকে সদ্য চালান বলে প্রতীয়মান হতে লাগল। পৌত্তলিকতী-দ্বেষে হিন্দু দেবদেবীর অভিধা প্রথম প্রথম ব্রহ্মসমাজীরাও বর্জন করে ছেলেমেয়ের নামকরণপরায়ণ হয়েছিলেন, তাঁরা নানারকম কবিত্বরসে ভরা সুন্দর সুন্দর ভাব বা প্রাকৃতিক বস্তু খুঁজে খুঁজে নাম দিতে লাগলেন। কিন্তু খ্রীস্টান মিশনারীদের হাতে কনভার্ট হওয়া ‘নেটিভ খ্রীস্টান’দের বিদেশীয় নামের আবরণের মত, মল্লাদের হাতে কনভার্ট হওয়া “নেটিভ মুসলিম’’দেরও নেটিভত্ব ঢাকা পড়তে লাগল বিদেশীয় নামের উত্তরীয়ে। সেটি খুলে ফেললেই তারা যে এদেশী নেটিভ, সেই এদেশী নেটিভ। এবার প্রধানত এই দুটি কারণে—নামগত ও ধর্মের আদর্শগত বা কৃষ্টির স্তরগত প্রভেদে আরবের মরুভূমিজাত অনেকগুলি প্রথা কনভার্ট মুসলমানেরা গ্রহণ করায় ভারতীয়দের শুচিজ্ঞানে খটকা দিলে। তেলেজলে মিশ খেলে না। দুদিকেই গোঁড়ামি পরস্পরের সঙ্গে ব্যবচ্ছেদ বাড়িয়ে দিলে। “সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ”—সুতরাং সেই গোঁড়ামিরূপ অর্ধটা ত্যাগ না করলে ভারতবাসীর আজ রক্ষা নেই। এই ছিল আমার সেদিনকার বক্তৃতার মূল কথা।
যে ‘জিনা’ আজ হিন্দুস্থানের বুকে বসে হিন্দুস্থানের মহা শত্রু হয়ে তার বুক চিরতে উদ্যত হয়েছেন—তাঁর নামই পরিচয় দিচ্ছে যে তিনি হিন্দুস্থানের বুকের সন্তান। ‘জিনা’ শব্দটি একটি গুজরাটি শব্দ, অর্থ তার ‘ছোট্ট’। দুই-এক পুরুষ আগে থেকে যদি ‘জিনা’ শব্দটি এই পরিবারে পদবীস্বরূপ চলে এসে থাকে, তাতে দেখায় কনভার্ট হওয়া পরিবারের কর্তাটি মায়ের কোলে যখন শিশু ছিলেন—মা যখন তাঁকে ‘জিনা’ বলে ‘আমার খুদু’ ‘আমার খোকন’ বলে আদর করতেন, মুখে চুমু খেতেন, তখন থেকেই ‘জিনা’ নামটি লেগে গেছে এই পরিবারে—