পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাবামহাশয়ের বিলেত যাওয়া স্থির হয়ে গিয়েছিল। তাঁর যাবার কিছু পূর্ব থেকে আমরা যে বাড়ি ছেড়ে যোড়াসাঁকোয় এলুম। যে যোড়াসাঁকো আমার জন্মভূমি তারই অঙ্গীভূত হলম এবার। যোড়াসাঁকো একেবারে ওতপ্রোতভাবে আমার জীবনকে জড়িয়ে নিলে।

 যোড়াসাঁকো বলতে কি বোঝায়—আমার মনে ও সাধারণের মনে? একটা বাড়ি শুধু? ইঁট কাঠ জানলা দরজা ছাদে উঠানে গড়া একটা প্রকাণ্ড ইমারত মাত্র, না তাদের ভিতর একটি স্বাতন্ত্র্যবান একটি নিজত্ববান সত্তা? অচেতনবৎ তাদের ভিতর চেতনার একটি সূত্রধারা বয় নাকি? তারা চেয়ে থাকে নাকি যে সব শিশুরা এর মাটিতে জন্মায়, খেলা করে, বেড়ে ওঠে, তাদের ত্রিকালজ্ঞ হয়ে তাদের দিকে? দু-তিন পুরুষানুক্রমে এ বাড়ি থেকে যে সব নরনারী সারা দেশে তাঁদের ম্যাগ্নেটিজম, বিকীর্ণ করে অস্তমিত হয়েছেন তাঁদের প্রতি? সেই ম্যাগ্নেটিজমের কিছু না কিছু আঁচ-লাগা-গায়ে যে সব শিশুরা এর প্রকোষ্ঠে বাস করেছিল, দালানে চত্বরে খেলা করে বেড়িয়েছিল তাদের প্রতি? দশের উপর দেশের উপর ভাবের ও কর্মের নেতৃত্বে এ বাড়ির যাঁরা জগতে ধন্যার্হ হয়েছেন তাঁদের স্মৃতিতে ধন্যর্হতা বোধ নেই কি এ বাড়ির? সঙ্গে সঙ্গে যাদের এই বাড়ির প্রতি অমর্যাদায় বাড়ি নগণ্য হয়ে গেল তাদের প্রতি করুণ দষ্টি নেই কি এই গহের গৃহ-দেবতার?

 হায় সে যোড়াসাঁকোর বাড়ি। সেদিনকার সে ভাবের তরঙ্গোদ্বেলিত, কর্মের গতি-হিল্লোলিত, নিশিদিন সঙ্গীত-মুখরিত যোড়াসাঁকো-আর আজকের মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের বংশের প্রায় সম্পর্কশূন্য এই পরিত্যক্ত পায়রাবিষ্ঠামলিন শূন্যপুরী। আগে যারা এ বাড়ির অঙ্গাঙ্গী ছিল তাদের মধ্যে কেউ যদি ফিরে এসে আজ বাড়ির আপাদমস্তকে তাকিয়ে অশ্রুভরা-আঁখি হয়ে দাঁড়ায়—বাড়িও কি তার দিকে তাকিয়ে তার চোখের জলে জল মেলায় না? হায় সেদিনকার সে বাড়ি—আর আজকেকার এই কখানা ইঁটকাঠ। এরাই বা আর কতদিন খাড়া থাকবে?

 আমি যখন প্রায় পাঁচ বছর বয়স থেকে জন্মপুরীতে ফিরে এসে তার হাওয়ায় মানুষ হতে লাগলাম, তখন সে পুরী জমজম গমগম করছে। প্রতি মহলে মহলে ঘরে ঘরে লোক। কর্তাদাদা মহাশয়ের ছেলেমেয়ে, জামাই-বউ, নাতি-নাত্নী, দাসদাসীতে বাড়ি ভরা। সে বাড়ির রান্নাঘরে দশ-বারজন বামন ঠাকুর ভোর থেকে রান্না চড়ায়। সে প্রকাণ্ড রান্নাঘরের দুপাশে দুভাগ করা মেঝেতে পরিষ্কার কাপড় পেতে ভাত