নিজের ভারার্পিত শিশুর দিকে টানত, ভাল খাবারটুকু যোগাড় করে তাকে দেবার চেষ্টা করত। তাদের নাওয়া ধোয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা সব দিকে দৃষ্টি রাখত। কিন্তু দাসীদের স্বাভাবিক প্রকৃতির বৈষম্য অনুসারে ছেলেদের প্রতি ব্যবহারে কোমলতা বা কঠোরতার তারতম্য হত। আমার গোড়ায় মানুষ করা যাদু দাই এখানে ছিল না। সে ছিল দেখতে সুন্দর আর কোমল-চিত্ত। আমায় খুব ভালবাসত,—যোড়াসাঁকোতে আমার টানে মাঝে মাঝে আসত। হাতে ঠোঙ্গায় ভরা কিছু না কিছু খাবার আর মুখে মিষ্টি আদর ও চুমু। কিন্তু তাতে যোড়াসাঁকোর ভাইবোনদের ঠাট্টার জ্বালায় যাদু, দাইকে দুর থেকে দেখলে লজ্জার পালাবার পথ পেতুম না। যোড়াসাঁকোয় এসে আমি যার হাতে পড়লুম, তার নাম মঙ্গলা। অতি কৃষ্ণবর্ণ হিন্দুস্থানী, জাতিতে গোয়ালা। আমায় যত্ন করত, কিন্তু কথায় কথায় মেরে মেরে চামড়া লাল করে দিতেও ছাড়ত না।
বাড়িভিতর এই ব্যাপার। বাইরে পড়বার ঘরে সতীশ পণ্ডিতমশায়ের হাতে মার খাওয়া আর একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। এ বাড়ির আর কোনো ছেলেমেয়ের আমাদের মত গৃহ-টিউটর ছিল না, শুধু আমাদেরই ছিল। তিনি চব্বিশ ঘণ্টাই বাড়িতে থাকতেন, এখানেই খেতেন দেতেন শুতেন। বাড়িভিতরের অঞ্চলে আমার অভিভাবিকা দাসী, বাইরের অঞ্চলে অভিভাবক মাস্টার—দুইই প্রহারমতি। মঙ্গলা দাসীর ছিল হাতের মার, সতীশ পণ্ডিতের ছিল রুলের মার। বাড়ির ভিতরে খেলতে খেলতে মামাতো মাসতুতো ভাইবোনদের কারো সঙ্গে ঝগড়া হলে তাঁরা শাসাতেন—“অ্যাঁ! মঙ্গলাকে বলে দেব।” বাইরে হলে বলতেন—“আচ্ছা! দাঁড়াও! সতীশ পণ্ডিতকে বলে দিচ্ছি।” এই দুই বলে দেওয়ার আগুনের মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলতে হত সাত বছরের বালিকাকে।
॥ তিন॥
বাইরে আমাদের পড়ার ঘরের পাশেই ছিল বড়মামা দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলেমেয়ের পড়ার ঘর। সেখানে পড়তেন নীতুদাদা, সুধীদাদা ও ঊষাদিদি