পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রায়ই একবার করে সেখানে ঢুঁ মেরে, তাঁদের খেলা দেখে দেখে খেলা শিখতুম, দু-একহাত তাঁদের সঙ্গে খেলতুমও। এই ছিল night-club সেকালের মেয়েদের যতক্ষণ না তাঁদের স্বামীরা বাড়ির ভিতরে না আসতেন। এই clubএ গিয়ে গিয়ে দশ-পঁচিশ ও তাসের বিন্তি খেলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলুম—এক এক সময় মাসিদেরও হারিয়ে দিতুম। কিন্তু তদূর্ধ্বে উঠতে পারি নি—গ্রাবুর ছক্কা পাঞ্জা আমার পক্ষে রহস্যলোকই রয়ে গেল। গ্রাবুটা একালের ব্রিজের অগ্রদূত। এ দুয়েতেই আমার কোন দক্ষতা হল না কোনকালে। এতে যতটা মাথা খেলাতে হয়, ততটার অবসর এবং রুচিও হয়নি আমার—না ছেলেবেলায় না বড় হয়ে।

 বাড়ির ছেলেমেয়েদের মধ্যে বড়মামার ছোট মেয়ে ঊষাদিদির সঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি ভাব। যোড়াসাঁকোর ছেলেমেয়েদের এক একটা group ছিল। আমাদের সাথী ছেলেদের মধ্যে নীতুদাদা, সুধীদাদা, বলুদাদা ও দাদা একদল এবং মেয়েদের মধ্যে সুশীলাদি ও দিদি একদল এবং তার চেয়ে আর একটি ছোট দলে ছিলুম সুপ্রভাদিদি, ঊষাদিদি ও আমি। সুপ্রভাদিদি আসলে সব দলেই ভুক্ত ছিলেন—তাই ঊষাদিদি ও আমি বেশি বন্ধু ছিলুম। ভয়ানক ভালবাসতুম তাঁকে। তিনি সুভাদিদির মত জীবন্ততায় ভরা নয়, অতি ঠাণ্ডা, সরল, সাদাসিদে। শিশুর ভালবাসা যে বড়দের মতই প্রগাঢ় হতে পারে তা বড়রা অনুমান করতে পারে না। ঊষাদিদির দাসী ছিল শঙ্করী—আমার যেমন মঙ্গলা। শঙ্করী খুব রুপকথা জানত। যখনই মঙ্গলার হাতছাড়া হয়ে পালিয়ে আসতে পারতুম ঊষাদিদিদের ঘরে গিয়ে তাঁদের প্রকাণ্ড তক্তপোষের বিছানায় মশারির ভিতর ঢুকে জড়াজড়ি করে শুয়ে শঙ্করীর রুপকথা শুনতুম। খুব ভোরে উঠে দুজনে গলা ধরাধরি করে বাড়ির ভিতরের বাগানে গিয়ে শিউলিফুল কুড়িয়ে আনতুম। শুকিয়ে গেলে তার বোঁটা জলে সিদ্ধ করে কাপড় ছোপান হত। সুপ্রভাদিদি ও ঊষাদিদি পরতেন শাড়ি—আমার পরিধান তখনও ইজের জামা। কাপড় রঙাবার জন্যে আর একটি জিনিসও পাওয়া যেত কখনো কখনো বাগানে—নটকানে। কিন্তু তাতে বড়রা দখল জমিয়ে রাখতেন—আমাদের তোলা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। সুন্দর হালকা নটকানে রঙের শাড়ি তাঁদের প্রায়ই অপরাহ্রে সাজ হত। বাগানে আমরা দল না বেঁধে যেতুম না, একা একা যেতে ভয় করত, সুপ্রভাদিদি দলপতি হয়ে আমাদের নিয়ে যেতেন। পাঁচিলের ওধারে সিংহীবাগান—পাছে সেখান থেকে কোন চোর পাঁচিল টপকে লাফিয়ে পড়ে সেই ভয়।

২০