পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পাল্কী বাড়ির ভিতরের দেউড়ীতে সর্বদাই মজুদ থাকত। দরকার হলে শুধু বেহারাদের তাদের বাড়ি থেকে ডেকে পাঠালেই হল।

 বারাণসী ঘোষ স্ট্রীট থেকে চাষা-ধোপা পাড়া বেরোত। সেখানে থাকতেন মাদের মামা ও মামী এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা। ছুটির দিন দু-আনার পাল্কী ভাড়া করে সেখানে যাওয়া আমাদের মস্ত একটা outing ছিল। ঐ দুটি আনা যোগাড় হলেই কি আনন্দের ডাকে আমরা সেখানে ছুটতুম, কি রসহ্রদে ডুবে মজে থাকতুম। ছোট্ট দোতালা বাড়ি, ছোট্ট উঠান, ছোট্ট পূজার দালান, ছোট্ট ছাদ—তার ভিতর বিশালহৃদয়া, সরল, সহাস্য, নাতিসুন্দরী মাদের মামী, আমাদের দিদিমা। মাদের মামা খাস যশুরে পিরিলি, দেখতে অতি সুন্দর, ধবধবে রঙ। নীচের ঘরেই পড়ে থাকেন। এঁদের বড় মেয়ে বিনোদা মাসি আমাদের ছোট মাসিমা বর্ণকুমারীর সমবয়সী ও বন্ধু। এঁদের বড় ছেলে বিমান মামা কিন্তু নীতু দাদাদের সমবয়সী। আমরা এখানে এসে কি করতুম? হড়োহুড়ি, গান, বাজনা, বড়দের দেখা অভিনয়ের নকল। আমাদের এক মামীর একটি বোনঝিও আসত আমাদের সঙ্গে। তার বেসুরা গলায় গান গাওয়ান ও তাতে হেসে হেসে গড়িয়ে পড়া ছিল আর এক মজা। কিন্তু তাকে জানতে দেওয়া হত না যে তার গানের জন্যে আমরা হেসে অস্থির। এ বিষয়ে নেত্রী ছিলেন সরোজা দিদি বা বড়দের কোন একজন। তাঁরা কেউ তাকে গান গাইতে উৎসাহ দিলে সে যখন গান ধরত আর উৎসাহদাত্রী হাসি সামলাতে অক্ষম হতেন, তখন ছোটদের একজনের উপর একটা দোষ চাপাতেন, “ও কি! দেখেছ! কি রকম সুড়সুড়ি দিচ্ছে!” বলে তখন খোলাখুলি সবাই মিলে হেসে বাঁচতেন। গায়িকা স্বপ্নেও সন্দেহ করত না যে তার গানই সবায়ের হাসির প্রবর্তক।

 এখানে আসা সম্বন্ধে আর একটি কথা মনে পড়ে। ছোটদের মনে কি রকম করে একটা ধারণা উপ্ত হয়েছিল যে, এঁদের অবস্থা ভাল নয়, যা মাসহারা পান তাতে বহুসন্তানিক এঁদের কষ্টে খরচ নির্বাহ হয়। সেইজন্যে শিশু হলেও বড়দেরই শিক্ষায় আমাদের মনে একটা কর্তব্যবোধ জাগ্রত হয়েছিল যে, এখানে আমোদ করতে এসে যেন এঁদের ঘাড়ে কোন খরচ না চাপাই। তাই আমরা নিজেরাই পয়সা দিয়ে দোকান থেকে সখের খাবারাদি আনাতুম, দিদিমার উপর কোন বোঝা চাপাতুম না। চাষা-ধোপা পাড়ার গলিটিতে যাতায়াত আমাদের ইস্কুল-জীবনেরই এক অঙ্গ ছিল। যেমন যেমন বড় হতে লাগলুম সেটা আস্তে আস্তে খসে যেতে লাগল।

২৪