পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ব্যতিক্রম বিধিগুলি তিনি সমর্থন করেন না, বঙ্কিম করেন—এই প্রভেদ। রবীন্দ্রনাথের দুই অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ বিষয়ে শাস্ত্রকারদের ও বঙ্কিমের পক্ষাবলম্বী হলেন, তাঁরা বক্তৃতা-সভায় যোগদান করলেন না। কিন্তু ছোটরা তাঁর hero-worshipper হল।

 তর্কের বিষয়টি বড় সূক্ষ্ম ও চিরকাল মানবসমাজের আলোচ্য। একপক্ষের অস্ত্রধারী হয়ে রবীন্দ্রনাথ যেন এইটিতে বঙ্কিমের Achilles' heel আবিষ্কার করে সেইখানে খোঁচা দিলেন। রবীন্দ্রের বক্তৃতা তৎকালীন ‘‘ভারতী”তে বেরিয়েছিল, বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্র রচনা সংগ্রহে সেইটি নিশ্চয়ই সন্নিবিষ্ট হয়ে থাকবে। কিন্তু বঙ্কিমকে বাঙালীর মনে চিরজাগরুক রাখবার কোন প্রতিষ্ঠান নেই। তাঁর যে শুধু ঔপন্যাসিক প্রতিভা ছিল না, সংস্কারের ও ভাবের গতানুগতিকতায় বাহিত না হয়ে বুদ্ধির প্রখর বিচারশীলতায় তিনি যে কত বড় ‘আধুনিক’, রবীন্দ্রের গুরু ও মার্গদর্শী তিনিই যে,—সে কথা এই পুরুষের বাঙ্গালীরা প্রায় জানে না। ‘সত্য’ সম্বন্ধে রবীন্দ্রের uncompromising আপোষশূন্য মনোভাবের অভিব্যক্তিতে সেদিন আমরা বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ হলুম। সত্যভক্তি আমাদের বুকে ক্ষোদিত করে দেওয়া হল। শিশুদের পক্ষে এইটেই দরকার। তাদের মনে ধর্মের নিয়মগুলির সংস্কারই বসিয়ে দেওয়া উচিত, ব্যতিক্রমের গহনে আগে থেকেই পা ফাঁসালে তাদের দুর্বল মন কথায় কথায় ব্যতিক্রমবিধির আড়ে মিথ্যাভাষণ ও মিথ্যা আচরণের আশ্রয় নেবে। শোনা যায় বিদ্যাসাগরমশায় তাঁর স্কুলের কোন পড়ুয়াকে মিথ্যা কথা কইতে শুনে বলেছিলেন,—“যাও বাবা, এখানে তোমার জায়গা হবে না, সেই আলিপুরের বটতলায় ‘টুর্নি’ বাবুদের কাছে গিয়ে বোসো।” কি শিশু, কি বড়, সকল মানুষেরই অন্তরের গভীর স্তরে কতকগুলি উচ্চ ভাব বসবাস করে। একখানা ব্রিটিশ Military Manual-এ পড়েছিলুম—“সৈন্যদের কেবলমাত্র হুকুমের দ্বারা চালাবে না। তাদের ভিতরকার সাহস প্রভৃতি উচ্চতম ভাব ও আদর্শের প্রতি appeal করে শত্রুজয়ে উদ্দীপিত করবে।” সত্যই পরম ধর্ম। কখনো কখনো অসত্যও ধর্মেরই রূপ; সুতরাং মার্জনীয়—এই কথা শাস্ত্রকাররা বলেছেন। সত্যই পরম ধর্ম। সত্যমিথ্যার ব্যবচ্ছেদ রেখাটি সুস্পষ্ট। কিন্তু কোন কোন অবস্থায় দেখতে অসত্য হলেও, তা ধর্মেরই রূপান্তর ও সেস্থলে ধর্মার্থে অসত্যই বিহিত—এই কথাটিই শ্রীকৃষ্ণের মুখে বঙ্কিম আমাদের শুনিয়েছেন।

৩৫