পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পারেন সে খেয়াল তাঁর মাথায় আসেনি। হঠাৎ আমাকে এক জায়গায় দেখতে পেয়ে ডাকতে আমি তাঁর কাছে গেলুম, আমার হাত ধরে ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুরোধে আমি তাঁর সঙ্গে সঙ্গে রইলুম। কিছু অসাধারণ কাজ করিনি, এ ছাড়া আর কিছু করা সম্ভবই ছিল না এ অবস্থায়। বাড়ি ফিরে গিয়ে বকুলফুল মার কাছে দিদির বিরুদ্ধে নালিশ আর আমার সম্বন্ধে তারিফ করলেন। উল্টো পূরাণ হল। আমি পেলুম ভীষণ লজ্জা—যেন দিদি ও মার কাছে অপরাধী! জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বকুলফুলের আমার প্রতি টান ও দিদির প্রতি মান যায়নি।

 দিদির ভিতর নেতৃত্ব ভাব ছিল বলেছি—সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাশক্তিও ছিল। তাঁর প্ল্যান করা, তাঁর দ্বারা “Conducted tour”এ ফণিদাদার কলেজের ছুটির সময় আমরা বছর বছর দেশভ্রমণে বেরতে লাগলুম। ফণিদাদাকে টেনে হিচ্‌ড়ে দিদিই নিয়ে যেতেন। যা-কিছু বন্দোবস্ত করার দিদিই করতেন—স্টেশনে স্টেশনে নামা, ব্রেকভ্যান থেকে লগেজ নামান, সঙ্গী চাকরকে দিয়ে খাওয়া-দাওয়ার যোগাড় করা—এ সবেরই কর্তা দিদি। ফণিদাদা বড় স্টীমারে জোড়া ঢেউয়ে ঢেউয়ে ধাক্কা খাওয়া একখানা জলিবোটের মত বিরক্ত হয়ে গজর গজর করতে করতে চলতেন। শেষ গন্তব্যে পৌঁছে থিতিয়ে বসে তবে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচতেন। আমি দিদিকে ঝঞ্ঝাট পোহাবার কতকটা সাহায্য করতুম। দাদা বিলেত চলে যাওয়ায় আর বাবামহাশয় আমাদের সঙ্গে যেতে অনিচ্ছুক হওয়ায় মা ও আমি এই দুজনেই কেবল দিদিদের সহযাত্রী হতুম। আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে দিদির সুখই হত না।

 দিদি “ভারতী”তে মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখে মায়ের সাহায্য করতেন। মৌলিক প্রবন্ধ তিনি লিখতেন না, কিন্তু প্রয়োজনীয় সাময়িক তথ্যের ইংরেজি হতে অনুবাদ করে বাঙলা পাঠকের সহজসাধ্য করা তাঁর কাজ ছিল। তাঁর নিজস্ব মৌলিক রচনা ছিল কতকগুলি সনেট। যেমন কারো কারো গানের গলা মিষ্টি ও করুণ, অথচ সে বড় গাইয়ে নয়—তাঁর কবিতাগুলি ছিল সেই রকম সুমিষ্ট ও সকরুণ।

 আমি যখন বি-এ পাসের পর মহীশূরে যাবার জন্যে ধরাধরি করলুম, আর অতিকষ্টে বাবামহাশয়ের সম্মতি পেয়ে সেখানে যাত্রা করলুম, দিদির প্রাণের সৌরভ আমার জন্যে দুটি সনেটের আকারে ‘ভারতী’তে বেরিয়ে আমার হাতে মহীশূরের প্রবাসে পৌঁছল। দিদি

৬২