পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ছেলেমেয়েরা দিদিমণিরই ছেলেমেয়ে যেন। তার দুটি ছেলে রবি, ছবি ও দুটি মেয়ে বীণা, বিভা। ছবির ভাল নাম অশোক—যিনি এখন স্যার এ কে রয়। তাকে দিদিমণি পোষ্য নিয়েছেন, লোকে দিদিমণিকেই তাঁর মা বলে জানে—বাড়িসুদ্ধ ছোটদের সবারই তিনি ‘মামণি’।

 বীণা স্কুলে যাবার যোগ্য হলে তাকে লরেটোতে পাঠান হল। সুন্দর মেয়েটির সুন্দর ঢলঢলে হাবভাব—সেজন্যে প্রাপ্য প্রশংসা প্রকৃতিদেবীর—আর সুন্দর তার পরিচ্ছদ—সেজন্যে প্রাপ্য প্রশংসা দিদিমণিদের সুরুচির। ছেলেবেলা থেকে লরেটোতে গিয়েও, ফিরিঙ্গি মেয়েদের সঙ্গে মেশামিশি করেও, বাড়িতেও ফিরিঙ্গি গবর্নেসদের দ্বারা পরিবৃত হলেও বীণার ভিতর এতটুকু ফিরিঙ্গিয়ানা প্রবেশ করতে পারলে না, দিদিমণিদের সুচারু অভিভাবকতায়।

 রসায়নশাস্ত্রে বলে এমন এক একটা ধাতু আছে যা সবেতে dissolve হয়ে যায়—মিশ খায়। আমার ভিতর বোধহয় সেই রকম কোন একটা পদার্থ ছিল যাতে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির লোকের সঙ্গেও মিশ খেয়ে যেতুম। খুসীর বড়দিদি মিসেস পি কে রায় আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়—আর আমার জাতীয় আদর্শ ও তাঁর আদর্শে মিল ছিল না—তবু তিনি আমাকে টানতে লাগলেন। তাঁর কতকগুলি গুণে আমি মোহিত হলুম। খুব আমুদে মজলিসী, হাসিখুশিতে ভরা, লোককে যত্ন করতে আপনার করে নিতে অদ্বিতীয়। তাঁর অন্তরে একটা seriousness—একটা গভীরতা ছিল, যা সচরাচর দেখা যায় না। বড় রকম কিছু-না-কিছু একটা করবার ইচ্ছা ভিতরে ভিতরে তাঁকে সর্বদা অনুপ্রেরিত করত। যদিও বাঙলা বেশী পড়েন নি—কিন্তু ইংরেজী ভারি সাহিত্যে Emerson প্রভৃতির রচনায় বিশেষ অনুরক্ত। তাঁদের লেখা নিয়ে, আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে আলোচনা করতে বসে যেতেন। সবচেয়ে ভাল লাগত আমার তাঁর একাধারে ইংরেজীয়ানা ও দিশীয়ানা। যখন বালিগঞ্জে ছিলেন, তখন রবিবার দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্যে তাঁর বাড়িতে প্রায়ই লোকসমাগম হত ও বিকেলে টেনিস খেলা হত, অনেক বাইরের লোক আসতেন। রাঁধুনে নেই হয়ত, অসুখ করেছে। ঘর্মাক্তদেহে সারাদিন নিজে রেঁধেবেড়ে—বাঙাল দেশের নানা সুস্বাদু ব্যঞ্জন ও বিকেলে চায়ের জন্য নানারকম খাবার—গা হাত ধুয়ে কাপড় ছেড়ে ফিটফাট হয়ে টেনিস কোর্টে যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে দুচার হাত টেনিস খেলতেন, অতিথিদের আপ্যায়িত করতেন, পীড়াপীড়ি করে এটা ওটা সেটা খাওয়াতেন। রোগীর সেবায়ও

৮৬