পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/১১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১২
জোড়াসাঁকোর ধারে

শুনছি তার সুর, কুল্‌ কুল্‌ ঝুপ্‌, কুল্‌ কুল্‌ ঝুপ্‌—আর চোখে দেখছি তার শোভা—সে কী শোভা, সেই ভরা গঙ্গার বুকে ভরা পালে চলেছে জেলে নৌকো, ডিঙি নৌকো। রাত্তিরবেলা সারি সারি নৌকোর নানারকম আলো পড়েছে জলে। জলের আলো ঝিলমিল করতে করতে নৌকোর আলোর সঙ্গে সঙ্গে নেচে চলত। কোনো নৌকোয় নাচগান হচ্ছে, কোনো নৌকোয় রান্নার কালে হাঁড়ি চেপেছে, দূর থেকে দেখা যেত আগুনের শিখা।

 স্নানযাত্রীদের নৌকো সব চলেছে পর পর। রাতের অন্ধকারে সেও আর এক শোভা গঙ্গার। গঙ্গার সঙ্গে অতি নিকট সম্বন্ধ তেমন ছিল না; চাকররা মাঝে মাঝে গঙ্গাতে স্নান করাতে নিয়ে যেত, ভালো লাগত না, তাদের হাত ধরেই দু-বার জলে ওঠানামা করে ডাঙার জীব ডাঙায় উঠে পালিয়ে বাঁচতুম। কিন্তু দেখেছি, এমন দেখেছি যে দেখার ভিতর দিয়েই গঙ্গাকে অতি কাছে পেয়েছি।

 তার পর বড় হয়ে আর একবার গঙ্গাকে আর এক মূর্তিতে দেখি। খুব অসুখ থেকে ভুগে উঠেছি নিজে ওঠবার বসবার ক্ষমতা নেই। ভোর ছটায় তখন ফেরি স্টীমার ছাড়ে, জগন্নাথ ঘাট থেকে শিবতলা ঘাট হয়ে ফেরে নটা সাড়ে নটায়। বিকেলেও যায়, আপিসের বাবুদের পৌঁছে দিয়ে আসে। ঘণ্টা দুই-আড়াই লাগে। ডাক্তার বললেন, গঙ্গার হাওয়া খেলে সেরে উঠব তাড়াতাড়ি। নির্মল আমায় ধরে ধরে এনে বসিয়ে দিলে স্টীমারের ডেকে একটা চেয়ারে। মনে হল যেন গঙ্গাযাত্রা করতে চলেছি। এমনি তখন অবস্থা আমার। কিন্তু সাত দিন যেতে না-যেতে গঙ্গার হাওয়ায় এমন সেরে উঠলুম, নির্মলকে বললুম, ‘আর তোমায় আসতে হবে না, আমি একাই যাওয়া-আসা করতে পারব।’

 সেই দেখেছি সেবারে গঙ্গার রূপ। গ্রীষ্ম বর্ষ শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত কোনো ঋতুই বাদ দিইনি, সব ঋতুতেই মা গঙ্গাকে দেখেছি। এই বর্ষাকালে দুকূল ছাপিয়ে জল উঠেছে গঙ্গার,—লাল টকটক করছে। জলের রং—তোমরা খোয়াইধোয়া জলের কথা বল ঠিক তেমনি, তার উপরে গোলাপী পাল তোলা ইলিশ মাছের নৌকো এদিকে ওদিকে দুলে দুলে বেড়াচ্ছে, সে কি সুন্দর। তার পর শীতকালে বসে আছি ডেকে গরম চাদর গায়ে জড়িয়ে, উত্তুরে হাওয়া মুখের উপর দিয়ে কানের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলেছে হু হু করে। সামনে ঘন কুয়াশা, তাই ভেদ করে স্টীমার চলেছে একটানা। সামনে কিছুই দেখা যায় না। মনে হত যেন পুরাকালের ভিতর দিয়ে নতুন যুগ চলেছে কোন রহস্য উদ্ঘাটন করতে।