পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জোড়াসাঁকোর ধারে
১২৫

করে সোনা লাগাতে হয়। সবরকম টেকনিক তো শেখ হল, তার পর আমাকে পায় কে? বৈষ্ণব পদাবলীর এক সেট ছবি সোনার রূপোর তবক ধরিয়ে এঁকে ফেললুম। তারপর ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ আঁকতে শুরু করলুম। সেই পদ্মাবতী পদ্মফুল নিয়ে বসে আছে, রাজপুত্তুর গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে; আর অন্যগুলিও। যাক রাস্তা পেলুম, চলতেও শিখলুম, এখন হু হু করে এগোতে হবে। তখন এক-একখানি করে বই ধরছি আর কুড়ি-পঁচিশখানা করে ছবি এঁকে যাচ্ছি। তাই যখন হল কিছুকাল গেল এমনি।

 তখন কি আর ছবির জন্য ভাবি, চোখ বুজলেই ছবি আমি দেখতে পাই—তার রূপ, তার রেখা, মায় প্রত্যেক রঙের শেড পর্যন্ত। তখন যে আমার কি অবস্থা বোঝাব কি তোমায়। ছবিতে আমার তখন মনপ্রাণ ভরপুর, হাত লাগাতেই এক-একখানা ছবি হয়ে যাচ্ছে।

 হু হু করে ছবি হতে লাগল। কৃষ্ণচরিত্র, বুদ্ধচরিত্র, বেতালপঞ্চবিংশতি ইত্যাদি। নিচের তলার দালানটাতে বসে মশগুল হয়ে ছবি আঁকতুম। আমি যখন কৃষ্ণের ছবি আঁকছি তখন শিশির ঘোষ মশায় ছিলেন পরম বৈষ্ণব। একদিন তিনি এলেন কৃষ্ণের ছবি দেখতে। আমি নিচের তলার ঘরটিতে বসে নিবিষ্টমনে ছবি আঁকছি, মুখ তুলে দেখি দরজার পাশে একটি অচেনা মুখ উঁকিঝুঁকি মারছে। আমি বললাম, ‘কে হে।’ তিনি বললেন, ‘আমি শিশির ঘোষ। তুমি কৃষ্ণের ছবি আঁকছ তাই শুনে দেখতে এলুম।’ আমি তাড়াতাড়ি উঠে ‘আসুন আসুন’ বলে তাঁকে ঘরে এনে ভাল করে বসিয়ে ছবিগুলি সব এক এক করে দেখাতে লাগলুম। তিনি সবগুলি দেখলেন, শেষে হেসে বললেন, “হুঁ, কি এঁকেছ তুমি? এ কি রাধাকৃষ্ণের ছবি? লম্বা লম্বা সরু সরু হাত পা যেন কাটখোট্টাই—এই কি গড়ন? রাধার হাত হবে নিটোল, নধর তাঁর শরীর। জান না তার রূপবর্ণনা?’ এই বলে তিনি চলে গেলেন। আমি খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইলুম কিন্তু তার কথায় মনে কোনো দাগ কাটল না। ছবি করে যেতে লাগলুম। তখন আমি বিলিতি ছবির কাগজ পড়িও না, দেখিও না, ভয় পাছে বিলিতি আর্টের ছোঁয়াচ লাগে। গানবাজনা আর ছবি নিয়ে মেতে ছিলুম। দিনরাত কেবল এসরাজ বাজাই, ছবি আঁকি।

 সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার