পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/১৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জোড়াসাঁকোর ধারে
১৪৫

সূর্য অস্ত গেলেন সমস্ত পাহাড়ের উপর ফাগের রঙ ছড়িয়ে দিয়ে। রাতের আকাশ ঘন নীল হয়ে এল—সন্ধ্যেতারা উঁকি দিলে কেলুগাছটার পাতার ফাঁকে। সেই সময়ে ধরলে দূর পাহাড়ে আবার বৈকালিক সুর, আরম্ভ হল পাখিদের গান আবার এ-পাহাড়ে ও-পাহাড়ে। একটি একটি করে সুর যেন ছুঁড়ে দিচ্ছে, লুফে লুফে নিচ্ছে পরস্পর। এমনি চলল কতক্ষণ। নীল আকাশের সীমা শুভ্র আলোয় ধুয়ে দিয়ে চন্দ্রও উঠলেন, পাখিরাও বন্ধ করলে তাদের বৈকালিক। সে যেন কিন্নরীদের গান, শুনে এসেছি রোজ দুবেলা।

 গান তো নয়, যেন চন্দ্রসূর্যকে বন্দনা করত তারা। কোথায় লাগে তোমাদের সংগীত, সভার ওস্তাদি সংগীত। মন টলিয়েছিল কিন্নরীর দল। তাই বহুদিন পরে কলকাতায় তারাই সব এক-এক করে ফুটে বের হল আমার এক রাশ পাখির ছবিতে। দেখে নিয়ো, তার ভিতরে সুর আছে কিছু কিছু, যদিও মাটির রঙে সব সুর ধরা পড়েনি। সে কত পাখি, সব চোখেও দেখিনি, কানে শুনেছি তাদের গান।

 মন কত ভাবে কত কি সংগ্রহ করে রাখে। সব যে বের হয় তাও নয় মনে হয়, হয়তো পূর্বজন্মেরও স্মৃতি থাকে কিছু। তাই তো ভাবি এক-একবার, লোকে যখন বলে পূর্বজন্মের কথা, উড়িয়ে দিতে পারিনে। নয়তো সারনাথে আমার ঘর খুঁজে পেলেম কি করে? দেখেই মনে হল এ আমার ঘর, এইখানে আমি থাকতুম, পুতুল গড়তুম, বেচতুম।

 সে একবার পুরানো সারনাথ দেখতে গেছি। শুধু স্তূপটি আছে, মাটির নিচের শহর একটু একটু খুঁড়ে বের করছে সবে। তখন সন্ধ্যে হচ্ছে। বরুণা নদী, একটি সাদা বক ওপার থেকে এপারে ফিরে এল। বড় শান্তিপূর্ণ জায়গা। ঘুরে ঘুরে দেখছি। মাটির উপর ছোট একটি ঘর, আরো ছোট তার দরজা। দরজার চৌকাঠের উপর দুটি হাস আঁকা। চৌমাথা, কুয়ো সামনে একটি, যেন রাস্তার ধারের ঘরখানি। দেখেই মনে হল যেন আমার নিজের ঘর, কোনোকালে ছিলুম। এত তো দেখলুম, কোথাও এমন মনে হয়নি। ঠিক যেন নিজের বাড়ি বলে মনে হল। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ঢুকলে যেমন মনে হয়, ওই ঘরটির সামনে গিয়ে আমার হল তাই। নেলিকে বললুম, ‘ওরে দেখ্‌, দেখ্‌। এইখানে বসে আমি পুতুল গড়তুম; তারই দু-চারটে ওই যে পড়ে আছে এখনো।’ অলকের মা শুনে বললেন, ‘ও আবার কি সব বলছ, চল চল এখান থেকে।’

 সব ছেড়ে ওই ঘরটার সামনে মন আমার থমকে দাঁড়াল, যেন মনের

১৯