পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
জোড়াসাঁকোর ধারে
৪১

বাড়িতে বারান্দায় বসে আছি। ভাগবত মরে গেছে অনেকদিন আগে, তার ছেলে এখন বাগানে কাজ করে। বাগানের কোণায় ছিল করবীগাছ। ছোট ছেলে বাপের হাতের সেই কাঁচি নিয়ে তার ডাল ছাঁটবার চেষ্টা করছে, কিছুতেই আর সামলাতে পারছে না, হাত আগডালে পৌঁছয় না তার। গাছের ডালপাতা হাওয়াতে দুলে দুলে ছেলেটিকে জাপটে ধরছে, কাঁচি হাতে সে তার ভিতরে আটকা প’ড়ে অস্থির। বসে আমি মজা দেখছি আর হাসছি। মোহনলাল শোভনলাল যাচ্ছিল সেখান দিয়ে, তাদের বললুম, ‘ওরে দেখ, মজা দেখ, ভাগবতের ছেলে তার বাপের লাগানো গাছের সঙ্গে কেমন খেলা করছে দেখ। যেন দুষ্টু ছেলের চুল কাটবে নাপিত, ছেলে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে নাপিতকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে। বলে দে ওকে, গাছের ডাল কাটবার দরকার নেই। ও-গাছ অমনি থাকুক।’ বাপের গাছের সঙ্গে ছেলে খেলা করছে দেখে ভারি ভালো লেগেছিল।

 ছেলেবেলায় বাবামশায়ের শখের বাগানে কেউ আমরা ঢুকতে পেতুম না, ভাগবত মালীর দাপটে। আমরা ছেলেরা কয়জনে মিলে একপাশে নিজেদের বাগান বানিয়ে নিয়েছিলুম। ছোট্ট বাগানটি, বাবামশায়ের দেখাদেখি একটা জায়গায় ইঁট পাথর জড়ো করে এখানে ওখানে ঘাসের চাপড়া বসিয়ে পাহাড়ের অনুকরণ করে, মাঝে মাটি খুড়ে একটা গোল মাটির গামলা বসিয়ে তাতে জল ভরে টিনের হাঁস মাছ ছেড়ে চুম্বক কাঠি দিয়ে টানি—সেই হল আমাদের গোলপুকুর। বিকেলে ইস্কুল থেকে সব ছেলে ফিরে এলে তখন আবার সবাই একসঙ্গে হয়ে খেলাধুলো করি। সারাদিন একলা থাকার পর ওই সময়টুকু বড় আনন্দে কাটত আমার।

 বিকেল হতেই বাগানে বাবামশায়ের কুরসি ফরসি পড়ে। ভাগবত ফোয়ারা ছেড়ে দেয়; সত্যিকার হাঁস মাছ ফেয়ারার জলে ভেসে বেড়ায়। বাবামশায় নিচে নেমে এসে বসেন বাগানে। পড়শি কালাচাঁদবাবু, মাথায় বুলবুলির ঝুঁটির মত একটু চুল, বুকে একটি ফুল গুঁজে, গলায় চুনটকরা চাদর ঝুলিয়ে, বার্নিশকরা জুতো প’রে, ছিপছিপে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে হেলেদুলে আসেন বাগানের মজলিসে। ফি শনিবার আপিস ছুটির পর মতিলালবাবু চলে আসেন বাবামশায়ের কাছে। মাছ ধরার খুব ঝোঁক ছিল তাঁর। বাবামশায় বলতেন, ‘এই যে লালমোতি এসেছ, ছিপটিপ ঠিক আছে তো?’ লালমোতি বলেই ডাকতেন তাঁকে। ওদিককার বড় পুকুরে লালমোতি প্রায়ই মাছ ধরতেন। বাবামশায়ও