পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
জোড়াসাঁকোর ধারে
৬১

 পূর্ণ মুখুজ্যে, মাথায় চুল প্রায় ছিল না, চাঁচা ছোলা নাক-মুখের গড়ন। তিনি মারা যাচ্ছেন, মাকে বলে পাঠালেন, ‘মা, আমি গঙ্গাযাত্রা করব।’ মা আমাদের বললেন, ‘বন্দোবস্ত করে দে।’ আমরা বন্দোবস্ত করে দিলুম। মারা গেলে যেভাবে নিয়ে যায় সেইভাবে বাঁশের খাটিয়া এনে তাঁকে তাতে শুইয়ে নিয়ে চলল। তেতলায় থেকে মা’রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, দোতলার বারান্দা থেকে আমরাও দেখছি— বুড়ো খাটিয়ায় শুয়ে সজ্ঞানে চারদিকে তাকাতে তাকাতে চলেছে। উপরে মাকে দেখতে পেয়ে দু হাত জুড়ে প্রণাম জানালেন—ঘাড় নেড়ে ইঙ্গিতে আমাদের জানালে, যাচ্ছি, ভাই সব। সরকার বরকার কাঁধে করে নিয়ে গেল তাকে ‘হরি বোল’ দিতে দিতে। এসবই দক্ষিণের বারান্দা থেকে দেখতুম, যেন বক্সে বসে এক-একটি সিন দেখছি। পরেশনাথের মিছিল গেল, বিয়ের শোভাযাত্রা গেল, আবার পূর্ণ মুখুজ্যেও গেল।

 মতিবাবু, তার ছবি তো দেখছ, দাদা এঁকেছেন—চেয়ারের উপর পা তুলে বসে বুড়ো হুঁকো খাচ্ছেন। হুঁকো খেয়ে খেয়ে গোঁফ হয়ে গিয়েছিল সোনালি রঙের। সকালে হয় আর্টের কাজ, সন্ধ্যেয় আসর জমাই মতিবাবুকে নিয়ে, গানের চর্চা করি। আমি ম্যাণ্ডোলিন বা এসরাজ বাজাই, তিনি পাঁচালি বা শিবের বিয়ে গেয়ে চলেন। বড় সরেশ লোক ছিলেন। ছেলের বিয়েতে আটচালা বাঁধতে হবে, মতিবাবু ছাড়া আর কেউ সে কাজ পারবে না। শহরের কোথায় কোথায় ঘুরে কাকে কাকে ধরে নকশামাফিক আটচালা বাঁধাবেন একপাশে বসে বুড়ো তামাক টানতে টানতে। এই মতিবাবু মরবার পরও দেখা দিয়েছিলেন, সে এক আশ্চর্য গল্প।

 মতিবাবুর একবার দুরন্ত অসুখ। ছেলে এসে বললে, আর বাঁচবেন না। দেশে নিয়ে গেল। খবরাখবর নেই, ভাবছি কি হল তাঁর। অনেকদিন পরে একদিন ফিরে এলেন, দিব্যি ফিটফাট লাল চেহারা নিয়ে। বললুম, ‘এমন সুন্দর চেহারা হল কি করে? মনেই হয় না যে অসুখে ভুগে উঠেছেন।’ তিনি বললেন, ‘না, এবার তো সেরে ওঠবার কথাই ছিল না। অসুখে ভুগছি, ডাক্তার-কবিরাজের ওষুধ খাচ্ছি। কিছুতেই কিছু না। শেষে একদিন গাঁয়ের এক মৌলবী বললে, ঠাকুর, ও ওষুধপত্রে কিছু হবে না। আমার একটি ওষুধ খাবেন? একটু করে সুরুয়া বানিয়ে এনে দেব রোজ। কতদিন যাবৎ ভুগছি, মৌলবীর কথাতেই রাজি হলেম। সেই সুরুয়া খেতে খেতেই দেখুন চেহারা কি রকম বদলে গেল।’ বললুম, ‘ভালোই তো, তা এখনো একটু একটু সুরুয়া চলুক না,