পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
জোড়াসাঁকোর ধারে
৬৩

টেনে খুলতে যেতুম, তিনি বলতেন, ‘খুলো না, ভাই, খুলো না। লাঠির ভিতরে একটি ময়ূর আছে, ছিপি খুললেই বেরিয়ে যাবে।’ মুর্শিদাবাদের গেঁটে বাঁশের দরোয়ানি লাঠি, নাটকে দরোয়ান সাজতে হত তাঁকে, তখন ওই লাঠি কাজে লাগত। সেই তিনিই বলেছিলেন, ‘জানো, ভাই? এবাড়িতে দাড়ির প্রচলন এই আমা হতেই।’ সেই লাঠিটি দিয়ে দাদার একটি ছবিতে ফ্রেম করেছিলুম।

 নবীনবাবুও ছিলেন বড় মজার লোক। বাজি রেখে চলন্ত মেল-ট্রেন থামিয়ে চাকরি খোয়ালেন। বাতে পঙ্গু হয়ে শুয়ে আছেন; চোর ঘরে ঢুকে সব জিনিসপত্তর নিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে, নড়বার শক্তি নেই, চেঁচিয়েই সারা। স্ত্রীর সঙ্গে একটু ঝগড়াঝাঁটি হ’লেই চাকর প্রেমলালকে ডাকতেন, ‘আমার ছুরিটা নিয়ে এসো, গলায় দেব। এ প্রাণ আর রাখব না।’ চাকর বেশ শানানো ছুরি এনে হাজির করলে বলতেন, ‘ওটা কেন? আমার সেই আম-কাটা ভোঁতা ছুরি নিয়ে এসো।’ এমন কত মজার মজার ঘটনা সব। তিনিও একদিন চলে গেলেন।

 মার বড় নাতি, দাদার বড় ছেলে গুপুর বিয়ে হল। দক্ষিণের বারান্দা ঝাড়ে লণ্ঠনে আটচালায় মতিবাবু একেবারে গন্ধৰ্বনগর করে সাজিয়ে দিলেন। নাচে গানে থিয়েটারে জমজমাট হয়ে উঠল বারমহল, অন্দরমহল, নাচঘর, বাগান, দক্ষিণের বারান্দা, সারা জোড়াসাঁকোর বাড়িটাই।

 তারপর কলকাতার প্লেগ এল, ভূমিকম্প এল। তেতলা বাড়ি ছেড়ে গেলুম চৌরঙ্গীতে। সেইখানে গুপু মেনিন্‌জাইটিস্ রোগে চলে গেল আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে। মা তার ছোট্ট বউকে বুকে নিয়ে কেঁদেছিলেন, ‘আমার সব পুরোনো শোক আজ আবার নতুন করে বুকে বাজল রে।’ ফিরে এলুম আবার সেই দক্ষিণের বারান্দাওয়ালা জোড়াসাঁকোর পারের বাড়িতে।

 মস্ত ঝড়খাওয়া জাহাজ যাত্রী নিয়ে ফিরে এসে লাগলো বন্দরে। মার মন খারাপ। কি করে তাঁদের মন শান্ত হয় সকলেরই এই ভাবনা। মা আবার ভাবছেন, আমরা কি করে সান্ত্বনা পাই। দিন যায় এইভাবে। দীনেশবাবু এলেন সে সময়ে, তিনি একদিন এনে উপস্থিত করলেন ক্ষেত্রনাথ চূড়ামণিকে। ঠিক হল রীতিমত ভাগবত কথা শুনব। মাকে বলে বন্দোবস্ত করা গেল। কথকের বেদী পাতা গেল নাচঘরে। কথকঠাকুর বেদী জমিয়ে বসলেন। ছেলে বুড়ো, চাকর দাসী, কর্মচারী, আত্মীয় বন্ধু সবার কাছে খবর রটে গেল—কথকতা হবে। চললো কথকতা মাসের পর মাস। খুব জমিয়ে তুললেন ক্ষেত্রনাথ কথক। যেন তিলেভাণ্ডেশ্বর মহাদেবটি, নধর কালো দেহ। চিকের আড়ালে মা বসে