পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন যে, তাঁহাদের গ্রামের নাম কুসুমঘাটী। মশা তৎক্ষণাৎ আপন অনুচরদিগকে কুসুমঘাটী পাঠাইলেন ও কঙ্কাবতীর প্রভুগণকে ডাকিয়া আনিতে আদেশ করিলেন! দূতগণ কুসুমঘাটীতে উপস্থিত হইয়া, অনেক সন্ধানের পর জানিতে পারিলেন যে, কঙ্কাবতীর অধিকারী তিনটি মশা। তাঁহাদের নাম, গজগণ্ড, বৃহৎমুণ্ড ও বিবৃততুণ্ড। রক্তবতীর পিতার নাম দীর্ঘশুণ্ড। দূতগণ শুনিলেন যে, কঙ্কাবতীর অধিকারিগণের বাস আকাশমুখ নামক শালবৃক্ষ। সেইখানে যাইয়া কঙ্কাবতীর অধিকারিগণকে সকল কথা তাঁহারা বলিলেন। তাঁহারা দূতগণের সহিত আসিয়া অবিলম্বে দীর্ঘশুণ্ডের নিকট উপস্থিত হইলেন। অনেক বাদানুবাদ, অনেক দর কষাকষির পর, তিন ছটাক নররক্ত দিয়া, কঙ্কাবতীকে দীর্ঘশুণ্ড কিনিয়া লইলেন! কঙ্কাবতীকে ক্রয় করিয়া তিনি কন্যাকে বলিলেন,— “রক্তবতী! এই নাও, তোমার পচাজল নাও! এ মানুষের ছানাটি এখন আমাদের নিজস্ব, ইহা এখন আমাদের সম্পত্তি।”

 দীর্ঘগুণ্ড, তাহার পর, গজগণ্ড, বৃহৎমুণ্ড, বিবৃততুণ্ড প্রভৃতি মশাগণকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,— “মহোদয়গণ! আমি দেখিতেছি, আমাদের ঘোর বিপদ উপস্থিত। ভারতবাসীগণের রক্তপান করিয়া পৃথিবীর যাবতীয় মশা এতদিন সুখে-স্বচ্ছন্দে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছিলেন। ভারতের তিনদিকে কালাপানি, একদিকে অত্যুচ্চ পর্ব্বতশ্রেণী। জীবজন্তুগণকে লোকে যেরূপ বেড়া দিয়া রাখে, ভারতবাসীগণকে এতদিন আমরা সেইরূপ আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম। ভারতের লোক ভারতে থাকিয়া এতদিন আমাদিগের সেবা করিতেছিল, বিনীতভাবে শোণিত-দান করিয়া আমাদের দেহ পরিপোষণ করিতেছিল। এক্ষণে কেহ কেহ মহাসাগর ও মহা পর্ব্বত উল্লঙ্ঘন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। এরূপ কার্য্য করিয়া রক্ত হইতে বঞ্চিত করিলে যে তাহাদের মহাপাতক হয়, তাহা আপনারা সকলেই জানেন। যেমন করিয়া হউক, ভারতবাসীগণকে সে দুষ্ক্রিয়া হইতে নিবৃত্ত করি। তাহার পর আবার, ভারতবাসীদিগের এক গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে গমনাগমন সুদীর্ঘকাল কিছু অধিক হইয়াছে। এই দেখুন, আজ সন্ধ্যাবেলা কুসুমঘাটী হইতে একটি শাবক আমার দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। সে মনুষ্য-শাবকটি আপনাদের সম্পত্তি আপনার সম্পত্তি পলাইবে, কাল আমার সম্পত্তি পলাইবে। এই প্রকারে মনুষ্যেরা যদি এক গ্রাম হইতে অপর গ্রামে যায়, তাহা হইলে সম্পত্তি লইয়া আমাদের মধ্যে মহা গোলযোগ উপস্থিত হইবে। তাহার পর আবার বুঝিয়া দেখুন, দেশভ্রমণের কি ফল! দেশভ্রমণ করিলে মনুষ্যেরা নানা নূতন বিষয় শিক্ষা করিতে পারে, মনুষ্যদিগের জ্ঞানের উদয় হয়। দেশভ্রমণ করিয়া ভারতবাসীদিগের যদি চক্ষু উন্মীলিত হয়, তাহা হইলে, মনুষ্যগণ আর আমাদের বশতাপন্ন হইয়া থাকিবে না। আবার বাণিজ্যাদি ক্রিয়া দ্বারা ক্রমে তাহারা ধনবান হইয়া উঠিবে। তখন মশারি প্রভৃতি নানা উপায় করিয়া, রক্তপান হইতে আমাদিগকে বঞ্চিত করিবে। অতএব, যাহাতে ভারতবাসীরা বিদেশে গমনাগমন না করিতে পারে, যাহাতে এক গ্রামের লোক অপর গ্রামে যাইতে না পায়, এরূপ উপায় সত্ত্বর আমাদিগকে করিতে হইবে।”

 দীর্ঘশুণ্ডের বক্তৃতা শুনিয়া সকলেই তাঁহাকে ধন্য ধন্য করিতে লাগিলেন। সকলেই বুলিলেন, দীর্ঘশুণ্ড অতি বিচক্ষণ মশা, দীর্ঘশুণ্ডের অতি দূর-দৃষ্টি, এরূপ বিজ্ঞ বুদ্ধিমান মশা পৃথিবীতে আর নাই। ভারতবাসীরা যাহাতে ভবিষ্যতে এক গ্রাম হইতে অন্য গ্রামে যাইতে না পারে, এরূপ উপায় করা অবশ্য-কর্ত্তব্য, তাহা সকলেই স্বীকার করিলেন। মশাগণ অনেক অনুধাবনা— অনেক বিবেচনা করিয়া অবশেষে স্থির করিলেন যে, পণ্ডিতদিগকে আহ্বান করিয়া একটি ভাল বিধি প্রচলিত করিতে হইবে, তবে লোকে সে বিধি প্রতিপালন করিবে; তা না হইলে লোকে মানিবে না। এইরূপ পরামর্শ করিয়া সমাগত মশাবৃন্দ ভারতের মহামহা পণ্ডিতদিগকে নিমন্ত্রণ

১০০
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ