পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বক্তা হইলেন, অর্থাৎ কি না খেতুর মুখ দিয়া ভূতিনী কথা কহিতে লাগিল। নানারূপ ঔষধ প্রয়োগ করিয়া, নানারূপ মন্ত্র পড়িয়া খর্ব্বুর নাকেশ্বরীকে ছাড়িয়া যাইতে বলিলেন। নাকেশ্বরী কিছুতেই ছাড়িবে না। নাকেশ্বরী বলিল যে,— “এ মনুষ্য ঘোরতর অপরাধে অপরাধী হইয়াছে, আমা-রক্ষিত সঞ্চিত ধন অপহরণ করিয়াছে। সেজন্য আমি ইহাকে কখনই ছাড়িতে পারি না, আমি ইহাকে নিশ্চয় ভক্ষণ করিব।” খর্ব্বুর পুনরায় নানারূপ মন্ত্রাদি দ্বারা নাকেশ্বরীকে অশেষ যন্ত্রণা দিতে লাগিলেন। যাতনা-ভোগে নিতান্ত অসমর্থ হইয়া, অবশেষে নাকেশ্বরী খেতুকে ছাড়িয়া যাইতে সম্মত হইল। কিন্তু 'যাই যাই' বলে, তবু কিন্তু যায় না। 'এইবার যাই, এইবার চলিলাম' বারবার এই কথা বলে, তবু কিন্তু যায় না। নাকেশ্বরীর শঠতা দেখিয়া খর্ব্বুর অতিশয় বিরক্ত হইলেন। ক্রোধে তাঁহার ওষ্ঠীদ্বয় কাঁপিতে লাগিল, ক্রোধে তাঁহার চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। খর্ব্বুর বলিলেন,— 'যাবে না? বটে! আচ্ছা দেখি, এইবার যাও কি না!' এই বলিয়া তিনি একটা কুষ্মাণ্ড আনয়ন করিলেন, মন্ত্রপূত করিয়া তাহার উপর সিন্দুরের ফোঁটা দিয়া কুমড়াটিকে বলিদান দিবার উদ্যোগ করিলেন। খর্পরে কুমড়াটি রাখিয়া খর্ব্বুর খড়্গ উত্তোলন করিলেন। কোপ মারেন আর কি! এমন সময় নাকেশ্বরী অতি কাতরস্বরে চীৎকার করিয়া বলিল,— 'রক্ষা করুন, রক্ষা করুন! কোপ মারিবেন না, আমাকে কাটিয়া ফেলিবেন না। আমি এখন সত্য সত্য সকল কথা বলিতেছি।'

 খর্ব্বর জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কি বলিবে বল? সত্য বল, কেন তুমি ছাড়িয়া যাইতেছ না। সত্য সত্য না বলিলে, এখনি তোমাকে কাটিয়া ফেলিব।”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “আমি ছাড়িয়া গেলে হইবে না। রোগী এখনি মরিয়া যাইবে। রোগীর পরমায়ুটুকু লইয়া কচুপাতে বাঁধিয়া তালগাছের মাথায় রাখিয়াছিলাম, মনে করিয়াছিলাম, মাসী আসিলে পরমায়ুটুকু বাটিয়া চাটনী করিয়া দুইজনে খাইব। তা, পরমায়ু-সহিত কচুপাতাটি বাতাসে তালগাছ হইতে পড়িয়া গিয়াছে। ক্ষুদ্র পিপীলিকাতে পরমায়ুটুকু খাইয়া ফেলিয়াছে। এখন আর আমি পরমায়ু কোথায় পাইব যে, রোগীকে আনিয়া দিব? সেইজন্য বলিতেছি যে, আমি ছাড়িয়া যাইলেই রোগী মরিয়া যাইবে।”

 খর্ব্বর গুণিয়া-গাঁথিয়া দেখিলেন যে, নাকেশ্বরী যাহা বলিতেছে, তাহা সত্যকথা,—মিথ্যা নয়। খর্ব্বুর মনে মনে ভাবিলেন যে,— “এইবার প্রমাদ হইল। ইহার এখন উপায় কি করা যায়? পরমায়ু না থাকিলে পরমায়ু তো আর কেহ দিতে পারে না?”

 অনেক চিন্তা করিয়া, খর্ব্বুর নাকেশ্বরীকে আদেশ করিলেন,— “যে ক্ষুদ্র পিপীলিকা ইহার পরমায়ু ভক্ষণ করিয়াছে, তুমি অনুসন্ধান করিয়া দেখ, সে খুদে পিপড়েরা এখন কোথায়?”

 নাকেশ্বরী গিয়া, তালতলায়, পাথরের ফাটালে, মাটির গর্ত্তে, কাঠের কোঠরে, সকল স্থানে সেই ক্ষুদ্র পিপীলিকাদিগের অন্বেষণ করিতে লাগিল। কোথাও আর তাহাদিগকে দেখিতে পাইল না। ডেওপিঁপড়ে, কাটপিঁপড়ে, শুড়শুড়ে-পিঁপড়ে, টোপ-পিঁপড়ে, যত প্রকার পিঁপড়ের সহিত সাক্ষাৎ হয়, সকলকেই নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী জিজ্ঞাসা করে,— “হাগা! খুদে-পিঁপড়েরা কোথায় গেল, তোমরা দেখিয়াছ?' খুদে-পিঁপড়ের তত্ত্ব কেহই বলিতে পারে না। বোনঝির বিপদে মাসীও ব্যথিত হইয়া চারিদিকে অন্বেষণ করিতে লাগিল। কিন্তু শীঘ্রই বুড়ীর হাঁপ লাগিল, চলিতে চলিতে নাকেশ্বরীর মাসীর পায়ে ব্যথা হইল। তখন নাকেশ্বরীর মাসী মনে করিল,— “ভাল দুঠেঙো মানুষের মাংস খাইতে আসিয়াছিলাম বটে! এখন আমার প্রাণ নিয়ে টানাটানি!”

 অনুসন্ধান করিতে করিতে অবশেষে কানাপিঁপড়ের সহিত নাকেশ্বরীর সাক্ষাৎ হইল! কানাপিঁপড়েকে নাকেশ্বৱী খুদে-পিঁপড়ের কথা জিজ্ঞাসা করিল। কানা-পিঁপড়ে বলিল— “আমি

কঙ্কাবতী
১০৭