পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ব্যাঙের হুড়-হুড় করিয়া বমন আরম্ভ হইল। পেটে যাহা কিছু ছিল, সমুদয় বাহির হইয়া পড়িল। ব্যাঙ বলিলেন,— “ব্যাঙাচি-অবস্থায়, জলে কিলকিল করিতে করিতে আমি যাহা কিছু খাইয়াছিলাম, তাহা পর্যন্ত বাহির হইয়া গিয়াছে, উদরে আর আমার কিছুই নাই।”

 বমনের সহিত সেই ক্ষুদ্র পিপীলিকাগুলি বাহির হইয়া পড়িল। খর্ব্বুর অতি যত্নে তাহাদিগকে বমনের ভিতর হইতে বাছিয়া লইলেন। তাহার পর একটি পিপীলিকা লইয়া, তাহার উদর হইতে অতি সূক্ষ্ম সোন্না-দ্বারা খেতুর পরমায়ুটুকু বাহির করিতে লাগিলেন! এইরূপে খুঁটিয়া খুঁটিয়া সমস্ত পিপীলিকাগুলি হইতে পরমায়ু বাহির করা হইলে, খর্ব্বুর বলিলেন,— “এ কি হইল? পরমায়ু তো অধিক বাহির হইল না! এ যৎসামান্য পরমায়ুটুকু লইয়া কি হইবে? ইহাতে তো কোনও ফল হইবে না?”

 খর্ব্বুর বিষণ্ন চিত্ত হইলেন, মশা হতাশ হইলেন, ব্যাঙের চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল, কঙ্কাবতী নীরবে বসিয়া রহিলেন। অদৃশ্যভাবে অবস্থিত নাকেশ্বরী ও তাহার মাসী পরিতোষলাভ করিল। যাহা হউক, সেই যৎসামান্য পরমায়ুটুকু লইয়া খর্ব্বুর খেতুর নাকে নাস দিয়া দিলেন। খেতু চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিলেন।

 খেতু বলিলেন,— “কি অঘোর নিদ্রায় আমি অভিভূত হইয়াছিলাম! কঙ্কাবতী! তুমি আমাকে জাগাইতে পার নাই? দেখ দেখি, কত বেলা হইয়া গিয়াছে?”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “সাধ্য থাকিলে আর জাগাইতাম না?”

 খেতু তাহার পর চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, কঙ্কাবতীর চক্ষু দিয়া জল পড়িতেছে। খর্ব্বুর, মশা ও ব্যাঙ বিষণ্নবদনে বসিয়া আছেন।

 খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কঙ্কাবতী! তুমি কাঁদিতেছ কেন? আর এঁরা কারা?”

 কঙ্কাবতী কোনও উত্তর করিলেন না।

{gap}}খেতু একটু চিন্তা করিয়া পুনরায় বলিলেন,— “আমার সকল কথা এখন মনে পড়িতেছে। আমার মাথায় শিকড় ছিল না বলিয়া আমাকে নাকেশ্বরী খাইয়াছিল। কঙ্কাবতী! তুমি বুঝি ইহাদিগকে ডাকিয়া আনিয়া আমাকে সুস্থ করিয়াছ? তবে আর কান্না কেন? আমি তো এখন ভাল আছি। কেবল আমার মাথা অল্প অল্প ব্যথা করিতেছে! আমি আর একবার শুই! কঙ্কাবতী! তুমি আমার মাথাটি একটু টিপিয়া দাও। আমার মাথা বড় বেদনা করিতেছে! প্রাণ বুঝি আমার বাহির হয়! ওগো! তোমরা সকলে আমার কঙ্কাবতীকে দেখিও! আমার কঙ্কাবতীকে তার মা’র কাছে দিয়া আসিও। হা ঈশ্বর!”

 খেতুর মৃত্যু হইল! ঘাড় হেঁট করিয়া সকলে নীরবে বসিয়া রহিলেন। কাহারও মুখে বাক্য নাই! সকলের চক্ষু দিয়া জলধারা পড়িতে লাগিল। কেবল কঙ্কাবতী স্থির হইয়া রহিলেন।

 অনেকক্ষণ পরে খর্ব্বুর বলিলেন,— “এইবার সব ফুরাইল। আমাদের সমুদয় পরিশ্রম বিফল হইল। এখন আর কোনও উপায় নাই। তালগাছ হইতে পতনের সময় পরমায়ুর অধিকাংশ ভাগ বাতাসে উড়িয়া গিয়াছিল, কেবল অতি সামান্য ভাগ পিপীলিকাতে খাইয়াছিল। সে পরমায়ুটুকুতে মনুষ্য আর কতক্ষণ বঁচিতে পারে?”

 এই বলিয়া খর্ব্বুর কাঁদিতে লাগিলেন, মশা কাঁদিলেন, ব্যাঙ রুমাল দিয়া চক্ষু মুছিতে লাগিলেন, বাহিরে হাতী শুড় দিয়া ধূলা উড়াইতে লাগিলেন। কেবল কঙ্কাবতী নীরব, কঙ্কাবতীর কান্না নাই।

১২২
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ