পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রাণসম কন্যাকে লইয়া যমের সহিত তুমুল যুদ্ধ করিতেছেন। প্রবল বিকারের উত্তেজনায় কন্যা যখন উঠিয়া বসেন, মা তখন আস্তে আস্তে পুনরায় তাহাকে শয়ন করান। বিকারের প্রলাপে কন্যা যখন চীৎকার করিয়া উঠেন, মা তখন তাঁহাকে চুপ করিতে বলেন। সুধাময় মা'র বাক্য শুনিয়া বিকারের আগুনও কিছুক্ষণের নিমিত্ত নির্ব্বাণ হয়।

 কন্যা নিদ্রিত! চক্ষু মুদ্রিত করিয়া আছেন। বহুদিন অনাহারে, প্রবল দুরন্ত জ্বরে ঘোরতর বিকারে, দেহ এখন তাঁর শীর্ণ, মুখ এখন মলিন। তবুও তাঁর মধুর রূপ দেখিলে সংসার সুন্দর বলিয়া প্রতীতি হয়। অনিমিষনয়নে মা সেই অপূর্ব্ব রূপরাশি অবলোকন করিতেছেন।

 রাত্রি প্রভাত হইল। বেলা হইল। তবুও রোগীর নিদ্রাভঙ্গ হইল না। মা কাছে বসিয়া রহিলেন। নিঃশব্দে ভগিনী আসিয়া মা'র কাছে বসিলেন।

 রোগীর ওষ্ঠীদ্বয় একবার ঈষৎ নড়িল। অপরিস্ফুট স্বরে কি বলিলেন। শুনিবার নিমিত্ত ভগিনী মস্তক অবনত করিলেন। শুনিতে পাইলেন না, বুঝিতে পারিলেন না।

 আবার ওষ্ঠ নড়িল, রোগী আবার কি বলিলেন। মা এইবার সে কথা বুঝিতে পারিলেন। মা বলিলেন,— “খেতু খেতু করিয়াই বাছা আমার সারা হইলেন, আজ কয়দিন মুখে কেবল ঐ নাম। এখন যদি চারিহাত এক করিতে পারি, তবেই মনের কালি যায়।”

 মা’র সুমধুর কণ্ঠ-স্বর কন্যার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। সম্পূর্ণরূপে জাগরিত হইয়া, ধীরে ধীরে তিনি চক্ষু উন্মীলন করিলেন। বিস্মিতবদনে চারিদিক নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।

 মা বলিলেন,— “বিকার সম্পূর্ণরূপে এখনও কাটে নাই। চক্ষুতে এখনও সুদৃষ্টি হয় নাই। তনু রায় একটু কাছে বসিলেন। স্নেহের সহিত কন্যার গায়-মাথায় একটু হাত বুলাইলেন। তাহার পর বাহিরে চলিয়া গেলেন।

 কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “মা, ভগিনী পিতা সকলেই দেখিতেছি আমার সহিত স্বৰ্গে আসিয়াছেন। পৃথিবীতে পিতার স্নেহ কখনও পাই নাই। আজ স্বর্গে আসিয়া পাইলাম। পৃথিবীতে আমাদের যেরূপ বাড়ী, আমার যেরূপ ঘর ছিল, স্বর্গেও দেখিতেছি সেইরূপ। কিন্তু যাহার সহিত সহমরণ যাইলাম, তিনি কোথায়?

 অনেকক্ষণ কঙ্কাবতী তার প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন। তিনি আসিলেন না। অবশেষে কঙ্কাবতী মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,— “মা, তিনি কোথায়?”

 মা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তিনি কে?”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “সেই যিনি বাঘ হইয়াছিলেন।”

 মা বলিলেন,— “এখনও ঘোর বিকার রহিয়াছে, এখনও প্রলাপ রহিয়াছে!”

 মা'র কথা শুনিয়া কঙ্কাবতী চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। শরীর তাঁহার নিতান্ত দুর্ব্বল, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন। অল্প অল্প করিয়া তাঁহার পূর্ব্বকথা সব স্মরণপথে আসিতে লাগিল।

কঙ্কাবতী
১২৭