পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “মা! আমার কি অতিশয় পীড়া হইয়াছিল?”

 মা বলিলেন,— “হাঁ বাছা! আজ বাইশ দিন তুমি শয্যাগত। তোমার কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না। এবার যে তুমি বাঁচিবে, সে আশা ছিল না।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মা! আমি আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিয়াছি। স্বপ্লটি আমার মনে এরূপ গাঁথা রহিয়াছে যে, প্রকৃত ঘটনা বলিয়া আমার বিশ্বাস হইতেছে। এখন আমার মনে নানা কথা আসিতেছে। তাহার ভিতর আবার কোনটি স্বপ্ন, তাহা আমি স্থির করিতে পারিতেছি না। তাই মা তোমাকে গুটিকত কথা জিজ্ঞাসা করি। আচ্ছা মা! জনার্দ্দন চৌধুরীর স্ত্রী-বিয়োগ হইয়াছে, সেকথা সত্য?”

 মা বলিলেন,— “সেকথা সত্য। তাই লইয়াই তো আমাদের যত বিপদ!”

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “মা! বরফ লইয়া কি দলাদলি হইয়াছিল, সেকথা কি সত্য?”

 মা উত্তর করিলেন,— “হাঁ বাছা! সেকথাও সত্য। সেই কথা লইয়া পাড়ার লোকে খেতুর মাকে কত অপমান করিয়াছিল।”

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তিনি এখন কোথায় মা!”

 মা বলিলেন,— “তিনি আসেন এই। সমস্ত দিন এইখানেই থাকেন। আমার চেয়ে তিনি তোমাকে ভালবাসেন। তাঁর হাতে তোমাকে একবার সঁপিয়া দিতে পারিলেই, এখন আমার সকল দুঃখ যায়। কর্ত্তার মত হইয়াছে, সকলের মত হইয়াছে, এখন তুমি ভাল হইলেই হয়।”

 কঙ্কাবতী বুঝিলেন যে, তবে খেতুর মা'র মৃত্যু হয় নাই, সে কথাটি স্বপ্ন।

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করলেন,— “এই দলাদলির পর আমার জ্বর হয়, না মা?”

 মা বলিলেন,— “এই সময় তোমার জ্বর হয় তুমি একেবারে অজ্ঞান অচৈতন্য হইয়া পড়। তোমার ঘোরতর জ্বর-বিকার হয়। আজ বাইশ দিন।

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “তাহার পর, মা, আমি নদীর ঘাটে গিয়া একখানি নৌকার উপর চড়ি, না মা?”

 মা বলিলেন,— “বালাই! তুমি নৌকায় চড়িবে কেন মা? সেই অবধি তুমি শয্যাগত।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মা! কত যে কি আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিয়াছি, তাহা আর তোমায় কি বলিব; সেসব কথা মনে হইলে, হাসিও পায় কান্নাও পায়। স্বপ্নে দেখিলাম কি মা, যে, গায়ের জ্বালায় আমি নদীর ঘাটে গিয়া জল মাখিতে লাগিলাম। তাহার পর একখানি নৌকাতে চড়িয়া নদীর মাঝখানে যাইলাম। নৌকাখানি আমার ডুবিয়া গেল। মাছেরা আমাকে তাদের রাণী করিল। তাহার পর কিছুদিন গোয়ালিনী মাসীর বাড়ীতে রহিলাম। সেখান হইতে শ্মশানঘাটে যাইলাম। তাহার পর পুনরায় বাড়ী আসিলাম। একবৎসর পরে আমাদের বাটীতে একটি বাঘ আসিল। সেই বাঘের সহিত আমি বনে যাইলাম। তারপর ভূতিনী, ব্যাঙ, মশা কত কি দেখিলাম। তারপর মা আকাশে উঠিলাম, কত কি করিলাম, কত কি দেখিলাম, স্বপ্নটি যেন আমার ঠিক সত্য বলিয়া বোধ হইতেছে। হা মা! সে দলাদলির কি হইল?”

 মা উত্তর করিলেন,— “সে দলাদলি সব মিটিয়া গিয়াছে। যখন তোমার সমূহ পীড়া, যখন তুমি অজ্ঞান অভিভূত হইয়া পড়িয়া আছ, আজ আট-নয় দিনের কথা আমি বলিতেছি, সেই সময় জনার্দ্দন চৌধুরীর একটি পৌত্রের হঠাৎ মৃত্যু হইল। জনার্দ্দন চৌধুরী সেই পৌত্রটিকে অতিশয় ভালবাসিতেন। তিনি শোকে অধীর হইয়া পড়িলেন। সেই সময় গোবৰ্দ্ধন শিরোমণিরও সঙ্কটাপন্ন পীড়া হইল। আর আমাদের বাটীতে তো তোমাকে লইয়া সমূহ বিপদ। জনার্দ্দন চৌধুরীর সুমতি হইল। তিনি রামহরিকে আনিতে পাঠাইলেন। রামহরি

১২৮
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ