পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পুস্তকখানি রহিয়াছে, প্রকৃত ইহা—কি, তাহার কিছুই জানি না। আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা কেবল কতকগুলি গুণ অনুভব হয়। চক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, ইহার দৈর্ঘ্য প্রস্থ স্থূলতা ও বর্ণ আছে, ত্বকের দ্বারা জানিতে পারি যে, ইহার কাঠিন্য আছে, নাসিকা দ্বারা ইহার ঘ্রাণ ও জিহ্বার দ্বারা ইহার স্বাদ অনুভব করি। প্রকৃত পুস্তকখানি আমরা দেখিতে পাই না, যাহাকে পুস্তকের গুণ বলি, তাহাই আমরা অনুভব করিতে পারি। কিন্তু সে গুণগুলি পুস্তকের কি আমাদের ইন্দ্রিয়ের? আমাদের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক প্রভৃতি এখন যেভাবে গঠিত, সেইভাবে আমরা গুণাদি অনুভব করি। যদি আমাদের ইন্দ্রিয়সমুদয় অন্যরূপে গঠিত হইত, তাহা হইলে পৃথিবীস্থ সমস্ত পদার্থ আবার অন্যরূপ ধারণ করত। এই পুস্তকের পত্রগুলি এখন শুভ্র ও কৃষ্ণবর্ণ দেখাইতেছে। যদি পাণ্ডুরোগে আক্রান্ত হইয়া, কিঞ্চিৎমাত্র আমার চক্ষুর গঠন পরিবর্ত্তিত হয়, তাহা হইলে এই পুস্তকখানিই আবার আমার চক্ষে পীতবর্ণ দেখাইবে। তাই দেখ, প্রথম তো পুস্তকখানি দেখিতে পাই না, কতকগুলি গুণ কেবল অনুভব করি। আবার বলিতে গেলে, সেই গুণগুলি পুস্তকের নয়, আমাদের ইন্দ্রিয়ের। তবে পুস্তক রহিল কোথা? কোনও বিষয়ের প্রকৃত তত্ত্ব জানিতে না পারিয়া স্বপ্নসৃজিত কাল্পনিক জীবের ন্যায় আমরা সকলেই এই সংসারে যেন বিচরণ করিতেছি। সে জন্য কঙ্কাবতীর স্বপ্নকে আমরা উপহাস করিব কেন? সমুদয় বাহ্যজগৎ যেরূপ আমাদের জাগরিত ইন্দ্রিয়-কল্পিত, কঙ্কাবতীর স্বপ্নজগৎও সেইরূপ কঙ্কাবতীর সুষুপ্ত ইন্দ্রিয়-কল্পিত। দুই জগতে বিশেষ কিছু ইতরবিশেষ নাই। কঙ্কাবতী যাহা দেখিয়াছে, যাহা শুনিয়াছে, যাহা কখনও চিন্তা করিয়াছ, সেই সমুদয় লইয়া একটি স্বপ্নজগৎ নির্ম্মিত হইয়াছিল। স্বপ্নের আদি হইতে অন্ত পর্য্যন্ত সকল স্থানেই কঙ্কাবতী বর্ত্তমান। কঙ্কাবতী দেখিতেছে, কি শুনিতেছে, কি বলিতেছে, কি ভাবিতেছে, তাছাড়া স্বপ্নে আর কিছুই নাই। কঙ্কাবতীর যেরূপ ভ্রম হওয়া সম্ভব, স্থানে স্থানে সেইরূপ ভ্রমও দেখিতে পাই। হাতীদিগের মত মশাদিগের নাক পরিবদ্ধিত হইয়া শুঁড় হয় না। দুই চল বাড়িয়া শুঁড় হয়। অন্য স্থানে, যেমন আকাশে কল্পনাদেবী কঙ্কাবতীর সহিত কিছু ক্রীড়া করিয়াছেন। যাহা হউক, স্বপ্নটি অদ্ভূত বলিয়া মানিতে হইবে। আমি আশ্চর্য্য হই, কঙ্কাবতী সেই মশাদিগের সংস্কৃত শ্লোকটি কি করিয়া রচনা করিল?”

 খেতু হাসিয়া বলিলেন,— “একবার পরিহাসচ্ছলে আমি ঐ বচনটি রচনা করিয়াছিলাম। এ অনেক দিনের কথা। একখানি কাগজে ইহা লিখিয়া রাখিয়াছিলাম। কিছুদিন পরে কাগজখানি ফেলিয়া দিই। কঙ্কাবতী বোধ হয়, সেই কাগজখানি দেখিয়া থাকিবে।”

 কঙ্কাবতী উত্তমরূপে আরোগ্য লাভ করিলে, শুভদিনে শুভলগ্নে খেতু ও কঙ্কাবতীর শুভবিবাহকার্য্য সম্পন্ন হইল। ঘোরতর দুঃখের পর এই কার্য্য সুসম্পন্ন হইল, সে জন্য সপ্তগ্রাম সমাজের লোক সকলেই আনন্দিত হইলেন। বিশেষতঃ জনার্দ্দন চৌধুরী পরম প্রীতিলাভ করিলেন। তাঁহার বৃদ্ধ বয়স ও কফের ধাত, কিন্তু সে জন্য তিনি কিছুমাত্র উপেক্ষা করেন নাই। বিবাহের দিন সমস্ত রাত্রি তিনি তনু রায়ের বাটীতে উপস্থিত ছিলেন। চুপি-চুপি তিনি কলিকাতা হইতে প্রচুর পরিমাণে বরফ আনয়ন করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ-ভোজনের সময় পরিহাসচ্ছলে সকলকে তিনি বলিলেন,— “বর যে একেলা বরখা খাইয়া শরীর সুশীতল করিবে, তাহা হইবে না, আমরাও আমাদের শরীর যৎসামান্য স্নিগ্ধ করিব।”

 দেশের লোক, যাঁহারা কখনও বরফ দেখেন নাই, আজ বরফ দেখিয়া সকলেই চমৎকৃত হইলেন। আগ্রহের সহিত সকলেই সুস্নিগ্ধ বরফ-জল পান করিলেন। বাড়ীতে দেখাইবার জন্য অনেকেই অল্প কাচা বরফ লইয়া গেলেন।

 শূদ্র-ভোজনের সময় গদাধর ঘোষ তিন লোটা বরফজল পান করিলেন। আর প্রায় একসের

১৩০
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ