পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আছে।” উদ্ধব দাদা উত্তর করিলেন,—“তোমরা যাও না কেন? মড়া পোড়াইতে আসিয়াছি, তা বলিয়া নিজের কাঁচা মাথাটি বাড়াইয়া দিতে পারি না।” এ বলে তুমি যাও; ও বলে তুমি যাও; কিন্তু যাইতে কাহারও সাহস হয় না। অবশেষে সকলে একসঙ্গে গাছের নিকট যাইলেন। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায় না, তথাপি সকলে জানিতে পারিলেন যে, গাছের ডালে একটি মানুষের মত কি বসিয়া রহিয়াছে। সকলে নিশ্চয় বুঝিলেন যে, তাঁহাদের মড়াটি দানো পাইয়া গাছে বসিয়া আছে। গাছ হইতে লাফ দিয়া এখনও খাইতে কি ঘাড় ভাঙ্গিতে আসিল না, সেজন্য সকলের মনে অনেকটা সাহসী হইল। দানো পাইলো যেরূপ প্রতিকার করিতে হয়, তখন সকলে সেইরূপ করিতে আরম্ভ করিলেন। দা, কোদাল, কুঠারি যাহার হাতে যা ছিল, সেই সকল ছুড়িয়া মারিতে লাগিলেন। গাছে নিধিরাম বসিয়া ছিলেন। গাছে বসিয়া তাঁহাদের কথাবার্ত্তা তিনি কতক কতক শুনিয়াছিলেন।

 নিধিরাম বলিলেন,— “মহাশয়গণ! আমাকে মারিবেন না। আমি আপনাদের মড়া নাই। আমি পথিক ব্রাহ্মণ, আজ রাত্রির ঝড়ে আমার নৌকা ডুবিয়া গিয়াছে। অতি কষ্টে আমার প্রাণ বঁচিয়াছে। প্রাতঃকালের প্রতীক্ষায় আমি এই গাছে বসিয়া আছি।”

 সকলে বলিলেন,— “আমাদের মড়া নয়, তবে শালা তুই কাদের মড়া? দানো পাইয়া মনের সুখে গাছে বসিয়া আছেন, আবার বলেন কি না,—'আমি তোমাদের মড়া নাই, আমি পথিক ব্রাহ্মণ!' নামিয়া আয়, শালা, শীঘ্র নামিয়া আয়!”

 নিধিরাম আস্তে আস্তে গাছ হইতে নামিয়া আসিলেন, যদিও অন্ধকার, তথাপি উদ্ধব দাদা প্রভৃতি সকলে দেখিলেন যে, লোকটি প্রকৃতই তো মড়া নয়। সকলে ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। সঙ্গে যে বোতল আনিয়াছিলেন, সকলে তাহা হইতে এক-আধা ঢোক মদ খাইলেন। পুনরায় মদ খাইয়া বুদ্ধি যখন উত্তমরূপে পাকিয়া উঠিল, তখন উদ্ধব দাদা বলিলেন,— “তা তুমি আমাদের মড়া হও আর নাই হও আমরা পোড়াইতে বাধ্য হইতেছি। কারণ, আমাদের নিজের মড়া কোথায় গিয়াছে, তাহার ঠিক নাই।”

 নিধিরাম বলিলেন,— “সে কি মহাশয়! আমি জীয়ন্ত মানুষ, আমাকে পোড়াইবার কথা কি বলেন! তামাসা করিতেছেন বুঝি?”

 উদ্ধব দাদা উত্তর করিলেন,— “তুমি আমার শালাসম্বন্ধী কিছুই নাও যে, তোমার সহিত তামাসা করিব! আমরা মড়া পোড়াইতে আসিয়াছি। শুধু হাতে কি করিয়া ঘরে ফিরিয়া যাই? তুমিই বুঝিয়া দেখ, সেটা কি ভাল কাজ হয়? অবুঝের মত কথা বলিও না। চল, ভালমানুষের মত পুড়িবে চল। গণ্ডগোল করিও না। চল যাদু, পুড়িবে চল।”

 নিধিরাম প্রথমে তামাসা মনে করিয়াছিলেন। অবশেষে বুঝিলেন যে, মাতালেরা সত্য সত্যই তাঁহাকে পোড়াইবে। তিনি অনেক অনুনয়-বিনয় করিলেন। পলাইবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। মাতালেরা বলপূর্ব্বক তাঁহাকে ধরিয়া চিতায় শয়ন করাইল, চিতার সহিত বাঁধিয়া দিল, নিম্নে পাতা ও পাকাটি দিয়া তাহাতে আগুন ধরাইয়া দিল।

 প্রাণে একবারে হতাশ হইয়া, নিধিরাম বলিলেন,—“যদি আমি তোমাদের মড়াই হইলাম, তবে আমাকে স্নান করাইয়া তাহার পর পোড়াও। সকলেই জানে যে মাড়াকে স্নান করাইয়া তাহার পর পোড়াইতে হয়।”

 সকলে বলিলেন,— “হা! একথা সত্য বটে। মড়াকে স্নান করাইয়া পোড়াইতে হয়।”

 আগুন নিবাইয়া নিধিরামকে চিতা হইতে তাহারা উঠাইলেন ও দুই জনে দুই হাত ধরিয়া

ভূত ও মানুষ
১৪৫