পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাহাকে স্নান করাইতে যাইলেন।

 নদীতে উপস্থিত হইয়া নিধিরাম বলিলেন,— “একবার ছাড়িয়া দাও, একটি ডুব দিই।”

 নিধিরাম ডুব দিলেন, কিন্তু আর উঠিলেন না। “মড়া পলাইল,” বলিয়া সকলে গোল করিয়া উঠিলেন। কিন্তু অন্ধকারে নিধিরামের সন্ধান তাহারা আর পাইলেন না। নিধিরাম নদীর স্রোতে ভাসিয়া চলিলেন। অনেকদূরে তিনি পুনরায় নদীর তীরে গিয়া উঠিলেন। কিন্তু সমস্ত রাত্রি জলে ভিজিয়া ও নানারূপে কষ্ট পাইয়া নিধিরামের শরীর একেবারে অবশ হইয়া গিয়াছিল! উপরে উঠিয়া তিনি অধিক দূর যাইতে পারিলেন না। তাঁহার ঘোরতর কম্প উপস্থিত হইল। সেই মাঠের উপর শুইয়া পড়িলেন। শয়ন করিতে না করিতে অজ্ঞান হইয়া যাইলেন।

 নদীর উপর প্রায় একক্রোশ মাঠ! মাঠের পর একখানি ক্ষুদ্র গ্রাম। গ্রামখানিতে কেবল চণ্ডাল ও মুসলমানের বাস। রাত্রিতে ঝড় হইয়াছিল। অনেক ডুবিয়া থাকিবে, জলমগ্ন নৌকায় দ্রব্যাদি পাইবে, এই আশায় প্রাতঃকাল হইতে না হইতে গ্রামের লোকে নদীর ধারে আসিয়াছিল। চণ্ডালেরা মৃতপ্রায় ভূতলশায়ী নিধিরামকে দেখিতে পাইল। তখনও তাঁহার দেহে প্রাণ ছিল। কোমরে তাহার টাকা আছে দেখিয়া কাহারও কাহারও লোভ হইল। তাহার নির্জ্জীব দেহটি নদীতে ফেলিয়া দিয়া টাকাগুলি লইবার নিমিত্ত কেহ কেহ পরামর্শ করিল। কিন্তু সেই চণ্ডালদিগের মধ্যে দুই-একজন বৃদ্ধ ছিল। নিধিরামকে ব্রাহ্মণ দেখিয়া, তাহারা এ প্রস্তাবে সম্মত হইল না; নিধিরামকে তাহারা বাটী লইয়া যাইল। অগ্নির উত্তাপ দিয়া ও নানারূপ সেবা করিয়া তাহারা নিধিরামকে কিঞ্চিৎ সুস্থ করিলা বটে, কিন্তু তাহার চেতন হইতে না হইতে জ্বর-বিকার উপস্থিত হইল। অনেক দিন তিনি এই চণ্ডালের গৃহে অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া রহিলেন। সম্পূর্ণভাবে আরোগ্যলাভ করিতে প্রায় একমাস অতীত হইয়া গেল। আরোগ্যলাভ করিলে, চণ্ডালেরা তাঁহাকে একখানি নৌকা করিয়া দিল, সেই নৌকা করিয়া নিধিরাম পুনরায় রামনগর অভিমুখে যাত্রা করিলেন।


ষষ্ঠ অধ্যায়

আড় কাটায়

নিধিরামের নিকট অনেক টাকা আছে, নৌকার মাঝিরা কেহ কেহ একথা শুনিয়াছিল। একদিন রাত্রিকালে নৌকার তলদেশে ছিদ্র করিয়া তাহারা নৌকাখানি ডুবাইবার উপক্রম করিল। শরীরে জল লাগিতেই নিধিরামের সহসা নিদ্রাভঙ্গ হইল। নৌকখানি সম্পূর্ণভাবে ডুবিতে না ডুবিতে তিনি জলে ঝাঁপ দিলেন। দাড়ি-মাঝিরাও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে জলে পড়িয়া তাঁহাকে ধরিল।

 কেহ হাত কেহ পা ধরিয়া জলে ডুবাইয়া তাহার প্রাণবধ করিতে চেষ্টা করিল। বাঁচিবার নিমিত্ত সেই অন্ধকার রাত্রিতে জলের মাঝখানে নিধিরাম মাঝিদের সঙ্গে ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু তিনি একলা, মাঝিরা চারিজন, কতকক্ষণ আর তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে পরিবেন? বারবার তাঁহাকে জলে ডুবাইয়া ক্রমে নির্জ্জীব করিয়া ফেলিল। আর অল্পক্ষণ পরেই মাঝিরা তাঁহার প্রাণবধ করিত, কিন্তু এই সময়ে কোথা হইতে একটি কুম্ভীর আসিয়া নিধিরামের

১৪৬
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ