পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলিল,— “ব্রাহ্মণ! তোমার খুব পরমায়ু! এস, তোমাকে গ্রামে যাইবার পথ দেখাইয়া দিই।” একটু দূরে গিয়া উপস্থিত হইলে সর্দ্দার বলিল,— “আমি কে জোন? আমি উদ্ধব দাদা। মদ খাইয়া সে দিন তোমার প্রাণবধ করিতে উদ্যত হইয়াছিলাম। ভাগ্যক্রমে সে দিন তুমি রক্ষা পাইয়াছিলে। আজ সাদা চক্ষে তোমার মাথা কাটিতে আমার প্রবৃত্তি হইল না। যাও; কিন্তু অন্ধকার রাত্রি, মাঠের পথ তুমি দেখিতে পাইবে না। কোনও গাছতলায় পড়িয়া রাত্রিযাপন কর। প্রাতঃকাল হইলে যেখানে ইচ্ছা যাইও।”

 সকাল হইলে নিধিরাম অতিকষ্টে নিকটস্থ একটি গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কুমীরের কামড়ে সর্ব্বশরীর তাহার ক্ষত-বিক্ষত হইয়া গিয়াছিল। পথ চলিবার তাঁহার শক্তি ছিল না। এই গ্রামে এক সদ্গোপের বাড়ী গিয়া আশ্রয় লইলেন। সেই স্থানে থাকিয়া যথাবিধি আপনার চিকিৎসা করাইতে লাগিলেন। আরোগ্যলাভ করিয়া পুনর্ব্বার রামনগর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। পথ চলিতে চলিতে বহুদূর চলিয়া যাইলেন। ক্রমে রামনগরের নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিলেন। এক-দিন সন্ধ্যাবেলা কোথাও বাসা না পাইয়া, তিনি একটি ব্রাহ্মণের বাড়ীতে অতিথি হইলেন। ব্রাহ্মণের দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ সাত বেটা। মকদ্দমা মামলা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, চুরি, ডাকাতি, সকল বিষয়ে তাহারা পরিপক্ক। কর্ত্তাটি মকদ্দমা করিতে রামনগর গিয়াছিলেন। পুত্রেরা নিধিরামকে চণ্ডীমণ্ডপে স্থান দিয়া আহারাদির সমুদয় আয়োজন করিয়া দিলেন। আহারাদি করিয়া নিধিরাম শয়ন করিয়া আছেন, এমন সময়ে পাশের একটি দ্বার দিয়া দুইটি বালক উঁকি মারিল! তারা দুই জনে বলাবলি করিতে লাগিলেন, —“ভাই! এই বামুনের কাছে অনেক টাকা আছে। আজ রাত্রিতে বাবা, কাকা, মিলিয়া ইহাকে মারিয়া ফেলিবেন। ইহার পালাইবার যো নাই। চারিদিকে তাঁহারা প্রহরা দিয়া আছেন। কি করিয়া মানুষ মারে, কখনও তাহা দেখি নাই। আয় ভাই, এক কর্ম্ম করি। আরও রাত্রি হইলে চুপি-চুপি বাটির ভিতর হইতে আসিয়া ঐ খড়ের গাদার ভিতর লুকাইয়া থাকিব। উহার ভিতর হইতে মানুষ মারা দেখিব।” নিধিরাম শুইয়া কথা শুনিলেন। প্রাণরক্ষার নিমিত্ত কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারেন না। চিন্তা করিয়া তিনি কোনওরূপে চণ্ডীমণ্ডপের আড়কাটার উপর উঠিয়া বসিয়া রহিলেন। রাত্রি যখন দুই প্রহর হইল, বাড়ীর কর্ত্তাটি রামনগর হইতে ফিরিয়া আসিলেন। চণ্ডীমণ্ডপের মাদুর ও বালিশ রহিয়াছে দেখিতে পাইলেন। মনে করিলেন, “রাত্রি অধিক হইয়াছে, কাহাকেও আর ডাকাডাকি করিব না। এইখানেই শুইয়া থাকি।” চাদর মুড়ি দিয়া নিধিরামের বিছানায় বাড়ীর কর্ত্তাটি শুইয়া রহিলেন। ঘোর রাত্রিতে ব্রাহ্মণের পুত্ররা লাঠি, বল্লম প্রভৃতি লইয়া চণ্ডীমণ্ডপের নিকট উপস্থিত হইল। দুই জন আস্তে আস্তে চণ্ডীমণ্ডপের উপর উঠিয়া তাঁহাদের নিদ্রিত পিতার মাথায় সবলে এক মুগুর মারিল। মস্তক একেবারে চূর্ণ হইয়া ব্রাহ্মণের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হইল। তাহার পর তাহারা ব্রাহ্মণের কোমরে হাত দিয়া টাকা অন্বেষণ করিতে লাগিল! কিন্তু টাকা পাইল না। ভাল করিয়া খুঁজিবার নিমিত্ত প্রদীপ আনিল। প্রদীপ আনিয়া দেখে না, পিতাকে হত্যা করিয়াছে! শোকে, ভয়ে, ক্রোধে সকলে আকুল হইয়া পড়িল। পথিক ব্রাহ্মণ কোথায় গেল? এই স্থানেই অবশ্য কোথায় লুকাইয়া আছে! এইরূপ চিন্তা করিয়া তাহারা প্রথমেই খড়ের গাদায় চারিদিক হইতে বল্লমের খোচা মারিতে লাগিল। খড়ের গাদার ভিতর হইতে বালক দুইটি ভয়ে “আঁ আঁ” করিয়া উঠিল, আর কিছুই বলিতে পারিল না। কিন্তু অধিক আর বলিতে হইলও না, সেই মুহূর্ত্তেই বল্লমের আঘাতে তাহারা প্রাণ

১৪৮
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ