পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একেবারে গিয়াছে। রক্তে রক্ত। নিধিরামের সেই সুন্দর, গৌরবান্বিত মুখখানি একেবারে পিণ্ডাকার হইয়া গিয়াছে। মনুষ্যের মুখ বলিয়া আর চিনিতে পারা যায় না।

 এককড়ির ঘরে সে রাত্রিতে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল। যাহা হউক, যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। নিধিরামকে বাঁচাইবার নিমিত্ত আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া সকলে যত্নবান হইলেন। সে রাত্রিতে নিধিরামের মৃত্যু হইল না। তাহার পরদিনও হইল না। তিন দিনের দিনও মৃত্যু হইল না। একটু যেন আশা হইল। কিন্তু জ্ঞান নাই, গোচর নাই, কিছু নাই। কেবল নিশ্বাসটি পড়িতেছে, এইমাত্র।

 হিরণ্ময়ী নিধিরামের সেবা করিতে লাগিলেন। হিরণ্ময়ী সর্ব্বদা অচেতন নিধিরামের নিকট বসিয়া থাকেন। নবীন প্রতিদিন নিধিরামকে দেখিতে আসেন। নিধিরামের নিকট অনেকক্ষণ ধরিয়া বসিয়া থাকেন। একদিন নবীন বলিলেন,—“হিরণয়ি! আমি শুনিয়াছি, তোমার সহিত আমার বিবাহের কথা হইয়াছিল। আমার পিতা অনেক টাকা চাহিয়াছিলেন, তাই হয় নাই। তখন যদি জানিতাম যে, তোমার কি অপূর্ব্ব রূপ, তুমি কি অমূল্য রত্ন, তাহা হইলে বাবাকে কি অমত করিতে দিতাম? মা-বাপের আমি একমাত্র সন্তান। আমাদের টাকা-কড়ির অভাব নাই। মায়ের নিকট কাঁদিয়া কাটিয়া যেমন করিয়া হউক, পিতাকে সম্মত করাইতাম। বড়ই দূরদৃষ্ট, হিরণ্ময়ি! যে, তোমার সহিত আমার বিবাহ হইল না।” হিরণ্ময়ী উত্তর করিলেন,— “মহাশয়! আমাকে ওরূপ কথা বলিবেন না।”

 হিরণ্ময়ী একথা বলিলেন বটে। কিন্তু সেই দিন তাহার চিত্ত একটু চঞ্চল হইল। একদিকে দরিদ্র, অৰ্দ্ধ বৃদ্ধ, একচক্ষুহীন, দন্তহীন, কিম্ভূতকদাকার ভয়াবহ নিধিরামের পিণ্ডাকার মুখ, অপরদিকে ধন-সম্পত্তি, নবযৌবনসম্পন্ন, রূপবান নবীনের মুখ। নিধিরাম না বাঁচেন, হিরন্ময়ীর এইরূপ একটু ইচ্ছা হইল। সেই দিন হইতে নিধিরামের সেবার একটু কমও পড়িল।

 তাহার পরদিন নবীন পুনরায় বলিলেন। সে দিন হিরণ্ময়ী আর তাঁহাকে বকিলেন না। তাহার পরদিন নবীন পুনরায় সেই ভাবের কথা বলিলেন। হিরণ্ময়ী ঘাড় হেঁট করিয়া শুনিতে লাগিলেন। চক্ষু দিয়া তাঁহার ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়িতে লাগিল। হিরণ্ময়ী অবশেষে উত্তর করিলেন,— “আমাকে এ সব কথা বলা বৃথা। আমি স্ত্রীলোক, আমার কি হাত আছে? আমার পিতা-মাতা আছেন, কিছু বলিতে হয়, তাহাদিগকে বলুন।” দুই দিন নবীন আর আসিলেন না। তাঁহাকে না দেখিয়া হিরণ্ময়ীর প্রাণ উদাস হইল। দুইদিন পরে নবীন আসিয়া হিরণ্ময়ীকে বলিলেন,— “আমি বাড়ী গিয়াছিলাম। তোমার সহিত বিবাহ-বিষয়ে আমার পিতামাতাকে সম্মত করিয়াছি। কিন্তু তোমার পিতা কিছুতেই সম্মত হইতেছেন না। তিনি বলিলেন,— “নিধিরামকে আমি কন্যা সমৰ্পণ করিয়াছি। নিধিরাম যদি এ যাত্রা রক্ষা না পান, তাহা হইলে জানিব, আমার কন্যা বিধবা হইয়াছে। বিধবা হইয়া কন্যা আমার ঘরে থাকিবে।” নবীন বিলাপ করিতে লাগিলেন, হিরণয়ীও কাঁদিতে লাগিলেন।

 যাহার পরমায়ু আছে, তাহাকে কে মারিতে পারে? নিধিরামের ক্রমে জ্ঞান হইল, নিধিরাম ক্রমে সুস্থ হইতে লাগিলেন। প্রায় একমাস পরে নিধিরাম উঠিয়া বসিতে পারিলেন। আরও কিছুদিন পরে তিনি একটু-আধটু চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইতে সমর্থ হইলেন! নিধিরামের প্রাণ বাঁচিল বটে, কিন্তু তাঁহার রূপ দেখিলে আর জ্ঞান থাকে না। মাথায় ও মুখের চারিদিকে সেলাই করার মত দাগ। একটি চক্ষুতে ঢেলা বাহির হইয়া পড়িয়াছিল। নাসিকাটি বিলুপ্তপ্রায়। দন্ত

ভূত ও মানুষ
১৫১