পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একটিও ছিল না। এরূপ কিম্ভূত-কদাকার রূপ কেহ কখনও দেখে নাই। দেখিলে ভয় হয়। “ইনি আমার পতি হইবেন!” এই কথা ভাবিয়া হিরণ্ময়ীর প্রাণ শিহরিয়া উঠিল।

 যে দিন হইতে নিধিরাম চেতন হইলেন, সেই দিন হইতে নবীন আর হিরণ্ময়ীর সহিত মনের কথা বলিতে পারিলেন না। নিধিরাম যখন একটু-আধটু বেড়াইতে সমর্থ হইলেন, তখন একদিন সুযোগ পাইয়া নবীন হিরণ্ময়ীকে বলিলেন,— “হিরণ্ময়ি! পৃথিবীতে আর আমাদের কোনও আশা-ভরসা নাই। তোমার নিকট দুইটা মনের কথা বলি, এরূপ অবসর আর পাইব না। আজ সন্ধ্যার পর যদি তুমি তোমাদের বাটীর পশ্চাতে অশ্বত্থতলায় একবার আসিতে পার, তাহা হইলে দুইটা মনের কথা বলিয়া তোমার নিকট হইতে চির বিদায় হই।

 হিরণ্ময়ী কোনও উত্তর করিলেন না। “যাইব কি না যাইব” সমস্ত দিন এই কথা ভাবিতে লাগিলেন। যাওয়া উচিত নয়, তাহা তিনি নিশ্চয় বুঝিলেন। কিন্তু পুনরায় ভাবিলেন,— “একবার যাই না কেন? একবার গিয়া চির বিদায় হইয়া আসি না কেন? তাহাতে আর দোষ কি?”


অষ্টম অধ্যায়

সব ফুরাইল

এককড়ি বাটীর পিছন অশ্বত্থ গাছ ছিল। অশ্বত্থ গাছের তলদেশ গোল করিয়া চারিদিক সান বাঁধানো ছিল। সন্ধ্যার সময় হিরণ্ময়ী নবীনের সহিত সেই অশ্বত্থতলায় সাক্ষাৎ করিলেন। দুইজনে কত কি বলিলেন, কত কি কহিলেন, কত কঁদিলেন। নবীন বলিলেন,— “আমি সংসার পরিত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হইয়া পথে পথে বেড়াইব।” হিরণ্ময়ী বলিলেন,— “বৃদ্ধের কদাকার মুখ মনে করিতে গেলে আর জ্ঞান থাকে না, ভয়ে সর্ব্বশরীর শিহরিয়া উঠে।”

 দৈবের ঘটনা! সেই দিন সন্ধ্যাবেলা নিধিরাম আসিয়া এই অশ্বত্থতলায় সানের উপর বসিয়াছিলেন। যে দিকে নিধিরাম বসিয়াছিলেন, তাহার বিপরীত দিকে বসিয়া হিরণ্ময়ী ও নবীনে কথাবার্ত্তা হইতেছিল। হিরণ্ময়ী ও নবীন নিধিরামকে দেখিতে পান নাই, কিন্তু নিধিরাম তাহাদিগের সকল কথা বসিয়া বসিয়া শুনিতেছিলেন। যখন হিরণ্ময়ী ও নবীন ঘোরতর খেদ, ঘোরতর কান্না-কাটনা করিতে লাগিলেন, তখন নিধিরাম আর থাকিতে পারিলেন না। নিধিরাম বলিলেন,— “নবীনবাবু! তুমি বাড়ী যাও। কাল তোমার মাতুলের সহিত আমি সাক্ষাৎ করিব। হতাশ হইও না, আমি নরাধম নই।” নবীন চমকিত হইলেন। নিধিরামের গুরু-গম্ভীর বাক্যে লজ্জিত হইয়া অধোবদনে সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

 নবীন চলিয়া যাইলে, নিধিরাম হিরণ্ময়ীকে বলিলেন,— “হিরণ্ময়ি। তোমার মনে এই ছিল? আমি কুরূপ কদাকার হইয়াছি সত্য! কিন্তু মন তো আমার সেই আছে। জীবন মন তো আমার হিরণ্ময়ীতে জড়িত হইয়া রহিয়াছে। আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি, হিরণ্ময়ি! এ বয়সে মনে কোনও একটা বিষয় অঙ্কিত হইয়া যাইলে তাহা আর মুছিয়া ফেলিবার যো নাই। তোমার জন্য আমি অনেক কষ্ট পাইয়াছি! হিরণ্ময়ি! সে কথা তুমি কিছুই জান না। হিরণ্ময়ি! কিন্তু সে কষ্ট কিছুই

১৫২
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ