পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একশত টাকা না পাইলে কন্যাদান করিতে পারি না।”

 কন্যা-কর্ত্তার এই কথায় বিষম গোলযোগ উপস্থিত হইল। সেই গোলযোগে লগ্ন অতীত হইয়া গেল, রাত্রি প্রায় অবসান হইল। যখন প্রভাত হয়, তখন পাঁচজনে মধ্যস্থ হইয়া এই মীমাংসা করিয়া দিলেন যে, “রায় মহাশয়কে আর পঞ্চাশটি টাকা দিতে হইবে।” “খত্” লিখিয়া তনু রায় আর পঞ্চাশ টাকা ধার করিলেন ও কন্যার পিতাকে তাহা দিয়া বিবাহকার্য্য সমাধা করিলেন।

 বাসরঘরে গাহিবেন বলিয়া তনু রায় অনেকগুলি গান শিখিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু সব বৃথা হইল। কারণ, বাসর হয় নাই, রাত্রি প্রভাত হইয়া গিয়াছিল। এ দুঃখ তনু রায়ের মনে চিরকাল ছিল।

 এক্ষণে তনু রায়ের তিনটি কন্যা ও একটি পুত্রসন্তান। কুল-ধর্ম্ম রক্ষা করিয়া দুইটি কন্যাকে তিনি সুপাত্রে অর্পণ করিয়াছিলেন। জামাতারা তনু রায়ের সম্মান রাখিয়াছিলেন। কেহ পাঁচশত, কেহ হাজার, নগদ গণিয়া দিয়াছিলেন। কাজেই সুপাত্র বলিতে হইবে।

 সম্মান কিছু অধিক পাইবেন বলিয়া, রায় মহাশয় কন্যা দুইটিকে বড় করিয়া বিবাহ দিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন,— “অল্পবয়সে বিবাহ দিলে, কন্যা যদি বিধবা হয়, তাহা হইলে সে পাপের দায়ী কে হইবে? কন্যা বড় করিয়া বিবাহ দিবে। কুলীন ও বংশজের তাহাতে কোন দোষ নাই! ইহা শাস্ত্রে লেখা আছে।”

 তাই, যখন ফুলশয্যার আইন পাশ হয়, তখন তনু রায় বলিলেন,— “পূর্ব্ব হইতেই আমি আইন মানিয়া আসিতেছি। তবে আবার নূতন আইন কেন?” আইনের তিনি ঘোরতর বিরোধী হইলেন; সভা করিলেন, চাঁদা তুলিলেন, চাঁদার সব আপনি লইলেন।

 তনু রায়ের জামাতা দুইটির বয়স নিতান্ত কচি ছিল না। ছেলেমানুষ বরকে তিনি দুটি চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারেন না। তাহারা একশত কি দুইশত টাকায় কাজ সারিতে চায়। তাই একটু বয়স্ক পাত্র দেখিয়া কন্যা দুইটির বিবাহ দিয়াছিলেন। একজনের বয়স হইয়াছিল সত্তর, আর একজনের পঁচাত্তর।

 জামাতাদিগের বয়সের কথায় পাড়ার মেয়েরা কিছু বলিলে, তনু রায় সকলকে বুঝাইতেন— “ওগো তোমরা জান না, জামাইয়ের বয়স একটু পাকা হইলে, মেয়ের আদর হয়।”

 জামাতাদিগের বয়স কিছু অধিক পাকিয়াছিল। কারণ, বিবাহের পর, বৎসর ফিরিতে না ফিরিতে দুইটি কন্যাই বিধবা হয়।

 তনু রায় জ্ঞানবান লোক। জামাতাদিগের শোকে একেবারে অধীর হন নাই। মনকে তিনি এই বলিয়া প্রবোধ দিয়া থাকেন,— “বিধাতার ভবিতব্য! কে খণ্ডাতে পারে? কত লোক যে বার বৎসরের বালকের সহিত পাঁচ বৎসর বালিকার বিবাহ দেয়, তবে তাহদের কন্যা বিধবা হয় কেন? যাহা কপালে থাকে, তাহাই ঘটে। বিধাতার লেখা কেহ মুছিয়া ফেলিতে পারে না।”

 তনু রায়ের পুত্রটি ঠিক বাপের মত। এখন তিনি আর নিতান্ত শিশু নয়, পঁচিশ পার হইয়াছেন। লেখা-পড়া হয় নাই, তবে পিতার মত শাস্ত্রজ্ঞান আছে। পিতা কন্যাদান করিয়া অর্থসঞ্চয় করিতেছেন, সে জন্য তিনি আনন্দিত, নিরানন্দ নন। কারণ, পিতার তিনিই একমাত্র বংশধর। বিধবা কয়টা আর কে বল? তবে বিধবাদিগের গুণকীর্ত্তন তিনি সর্ব্বদাই করিয়া থাকেন।

 তিনি বলেন,— “আমাদের বিধবারা সাক্ষাৎ সরস্বতী। সদা ধর্ম্মে রত, পরোপকার ইহাদের চিরব্রত। কিসে আমি ভাল খাইব, কিসে বাবা ভাল খাইবেন, ভগিনী দুইটির সর্ব্বদাই এই

ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ