পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চিন্তা। তিন দিন উপবাস করিয়াও আমাদের জন্য পাঁচব্যঞ্জন রন্ধন করেন। ভগিনী দুইটি আমার— অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরীস্তথা। প্রাতঃস্মরণীয়া।”

 আজকাল আর সহমরণ প্রথা নাই বলিয়া, ইনি মাঝে মাঝে খেদ করেন। কারণ, তাহা থাকিলে ভগিনী দুইটি নিমিষের মধ্যেই স্বর্গে যাইতে পারিতেন। বসিয়া বসিয়া মিছামিছি বাবার অন্নধ্বংস করিতেন না।

 সাহেবেরা স্বর্গের দ্বারে এরূপ আগড় দিয়া দেন কেন?

 তনু রায়ের স্ত্রী কিন্তু অন্য প্রকৃতির লোক। এক-একটি কন্যার বিবাহ হয়, আর পাত্রের রূপ দেখিয়া তিনি কান্নাকাটি করেন। তনু রায় তখন তাঁহাকে অনেক ভর্ৎসনা করেন, আর বলেন,— “মনে করিয়া দেখ দেখি, তোমার বাপ কি করিয়াছিলেন?” এইরূপ নানাপ্রকার খোঁটা দিয়া তবে তাঁহাকে সান্ত্বনা করেন। কন্যাদিগের বিবাহ লইয়া স্ত্রীপুরুষের চিরবিবাদ। বিধবা কন্যা দুইটির মুখপানে চাহিয়া সদাই চক্ষের জলে মায়ের বুক ভাসিয়া যায়। মেয়েদের সঙ্গে মাও একপ্রকার একাদশী করেন। একাদশীর দিন কিছুই খান না, তবে স্বামীর অকল্যাণ হইবার ভয়ে, কেবল একটু একটু জলপান করেন।

 প্রতিদিন পূজা করিয়া একে একে সকল দেবতাদিগের পায়ে তিনি মাথা খুঁড়েন, আর তাঁহাদের নিকট প্রার্থনা করেন যে,— “হে মা কালি। হে মা দুর্গা! হে ঠাকুর! যেন আমার কঙ্কাবতীর বরটি মনের মত হয়।”

 কঙ্কাবতী তনু রায়ের ছোটকন্যা। এখনও নিতান্ত শিশু।


চতুর্থ পরিচ্ছেদ

খেতু

তনু রায়ের পাড়ায় একটি দুঃখিনী ব্রাহ্মণী বাস করেন। লোকে তাঁহাকে “খেতুর মা, খেতুর মা” বলিয়া ডাকে। খেতুর মা আজি দুঃখিনী বটে, কিন্তু একসময়ে তাহার অবস্থা ভাল ছিল। তাঁহার স্বামী শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখা-পড়া জানিতেন, কলিকাতায় কর্ম্ম করিতেন, দু'পয়সা উপার্জ্জন করিতেন।

 কিন্তু তিনি অর্থ রাখিতে জানিতেন না। পরদুঃখে তিনি নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িতেন ও যথাসাধ্য পরের দুঃখ মোচন করিতেন। অনেক লোককে অন্ন দিতেন ও অনেকগুলি ছেলের তিনি লেখা-পড়ার খরচ দিতেন। এরূপ লোকের হতে পয়সা থাকে না।

 অধিক বয়সে তাহার স্ত্রীর একটি পুত্রসন্তান হয়। ছেলেটির নাম “ক্ষেত্র” রাখেন, সেই জন্য তাহার স্ত্রীকে সকলেই “খেতুর মা” বলে।

 যখন পুত্র হইল, তখন শিবচন্দ্র মনে করিলেন,— “এইবার আমাকে বুঝিয়া খরচ করিতে হইবে। আমার অবর্ত্তমানে স্ত্রী-পুত্র যাহাতে অন্নের জন্য লালায়িত না হয়, আমাকে সে বিলি করিতে হইবে।”

 মানস হইল বটে, কিন্তু কার্য্যে পরিণত হইল না। পৃথিবী অতি দুঃখময়, এ দুঃখ যিনি নিজ

কঙ্কাবতী