পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কোন দোষ নাই, তার জন্য জেলেরা তোমাকে বকিবে না। কিন্তু গাছের ডগায় গিয়া উঠিও না, সরু ডালে পা দিও না, ডাল ভাঙ্গিয়া পড়িয়া যাইবে। গাবের আঁটি চুষিয়া চুষিয়া ফেলিয়া দিও, আঁটি গিলিও না, গলায় বাধিয়া যাইবে।” গাব খাইতে অনুমতি পাইয়া বাছার যে কত আনন্দ হইল, তাহা আর তোমাকে কি বলিব?

 “দেখ, এ গ্রামে একবার একজন কোথা হইতে সন্দেশ বেচিতে আসিয়াছিল। পাড়ার ছেলেরা তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। তাদের বাপ-মা, যার যেরূপ ক্ষমতা, সন্দেশ কিনিয়া আপনার আপনার ছেলের হাতে দিল। মুখ চূণপানা করিয়া আমার খেতু সেইখানে দাঁড়াইয়াছিল। তাড়াতাড়ি গিয়া আমি খেতুকে কোলে লইলাম, আমার বুক ফাটিয়া যাইল, চক্ষুর জল রাখিতে পারিলাম না। আঁচলে চক্ষু পুছিতে পুছিতে ছেলে নিয়ে বাটী আসিলাম। খেতু নীরব, খেতুর মুখে কথা নাই। তার শিশুমনে সে যে কি ভাবিতেছিল, তাহা বলিতে পারি না। কিছুক্ষণ পরে আমার মুখে হাত দিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল,— ‘মা! তুমি কাঁদা কেন?' আমি বলিলাম,— 'বাছা! আমার ঘরে একদিন সন্দেশ ছড়াছড়ি যাইত, চাকর-বাকরে পর্য্যন্ত খাইয়া আলিয়া যাইত। আজ যে তোমার হাতে একপয়সার সন্দেশ কিনিয়া দিতে পারিলাম না, এ দুঃখ কি আর রাখিতে স্থান আছে? এমন অভাগিনী মা’র পেটেও বাছা তুই জন্মেছিলি?' সাত বৎসরের শিশুর একবার কথা শুনা! খেতু বলিল,— “মা ও সন্দেশ ভাল নয়। দেখিতে পাও নাই, সব পচা? আর মা! তুমি তো জোন? সন্দেশ খাইলে আমার অসুখ করে। সেই যে মা, চৌধুরীদের বাড়ীতে নিমন্ত্রণে গিয়াছিলাম, সেখানে সন্দেশ খাইয়াছিলাম, তার পরদিন আমার কত অসুখ করিয়াছিল! সন্দেশ খাইতে নাই, মুড়ি খাইতে আছে। ঘরে যদি মা! মুড়ি থাকে তো দাও আমি খাই।”

 খেতুর মার মুখে খেতুর কথা আর ফুরায় না।রামহরির নিকট কত যে কি পরিচয় দিলেন, তাহা আর কি বলিব?

 অবশেষে রামহরি বলিলেন, — “খুড়ী মা! ভয় করিও না। আমার নিজের ছেলের চেয়েও আমি খেতুর যত্ন করিব। আমি অনেক খাইয়াছি। তাহার অনুগ্রহে আজ পরিবারবর্গকে একমুঠা অন্ন দিতেছি। আজ তাঁহার ছেলে যে মুর্খ হইয়া থাকিবে, তাহা প্রাণে সহ্য হবে না। খেতু কেমন আছে, কেমন লেখা-পড়া করিতেছে, সে বিষয়ে আমি সর্ব্বদা আপনাকে পত্র লিখিব। আবার, খেতু যখন চিঠি লিখিতে শিখিবে, তখন সে নিজে আপনাকে চিঠি লিখিবে। পূজার সময় ও গ্রীষ্মের ছুটির সময় খেতুকে দেশে পঠাইয়া দিব। বৎসরের মধ্যে দুই-তিন মাস সে আপনার নিকট থাকিবে। আজ আমি এখন যাই। আজ শুক্রবার। বুধবার ভাল দিন। সেই দিন খেতুকে লইয়া কলিকাতায় যাইব।”

১০
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ