পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 তনু রায় বলিলেন,— “স্ত্রীলোকের আবার লেখাপড়া কেন? লেখাপড়া শিখিয়া আর কাজ নাই।”

 না বুঝিয়া তনু রায় এই কথাটি বলিয়া ফেলিলেন। কিন্তু যখন তিনি স্থিরভাবে বিবেচনা করিয়া দেখিলেন, তখন বুঝিতে পারিলেন যে, লেখাপড়ার অনেক গুণ আছে।

 আজকালের বরেরা শিক্ষিতা কন্যাকে বিবাহ করিতে ভালবাসে। এরূপ কন্যার আদর হয়, মূল্যও অধিক হয়।

 তবে কথা এই—কাজটি শাস্ত্রবিরুদ্ধ কি না? শাস্ত্রসম্মত না হইলে তনু রায় কখনই মেয়েকে লেখাপড়া শিখাইতে দিবেন না। মনে মনে তনু রায় শাস্ত্রবিচার করিতে লাগিলেন।

 বিচার করিয়া দেখিলেন যে, স্ত্রীলোকের বিদ্যাশিক্ষা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ বটে, তবে এ নিষেধটি সত্য ত্রেতা দ্বাপর যুগের নিমিত্ত, কলিকালের জন্য নয়। পূর্ব্বকালে যাহা করিতে ছিল, এখন তাহা করিতে নাই। তাহার দৃষ্টান্ত, নরমেধযজ্ঞ। এখন মানুষ বলি দিলে ফাঁসি যাইতে হয়। আর এক দৃষ্টান্ত—সমুদ্রযাত্রা এখন করিলে জাতি যায়।

 তাই তনু রায়ের মা যখন জীবিত ছিলেন, তখন তিনি একবার সাগর যাইতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু তনু রায় কিছুতেই পাঠান নাই।

 মাকে তিনি বুঝাইয়া বলিলেন,— “মা! সাগর যাইতে নাই। সমুদ্রযাত্রা একেবারে নিষিদ্ধ। শাস্ত্রের সঙ্গে আর সমুদ্রের সঙ্গে ঘোরতর আড়ি। সমুদ্র দেখিলে পাপ, সমুদ্র ছুইলে পাপ। কেন মা পয়সা খরচ করিয়া পাপের ভার কিনিয়া আনিবে? কেন মা জাতি-কুল বিসৰ্জ্জন দিয়া আসিবো?”

 এক্ষণে তনু রায় বিচার করিয়া দেখিলেন পূর্ব্বকালে যাহা করিতেছিল, এখন তাহা করিতে নাই। সুতরাং পূর্ব্বকালে যাহা করিতে মানা ছিল, এখন তাহা লোকে স্বচ্ছন্দে করিতে পারে। স্ত্রীলোকদিগের লেখাপড়া শিক্ষা করা পর্ব্বে মানা ছিল, তাই এখন তাহাতে কোনও রূপ দোষ হইতে পারে না।

 শাস্ত্রকে তনু রায় এইরূপ ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া গড়িলেন। শাস্ত্রটি যখন মনের মতন গড়া হইল, তখন তিনি স্ত্রীকে বলিলেন,— “আচ্ছা! খেতু যদি কঙ্কাবতীকে একটু-আধটু পড়িতে শিখায়, তাহাতে আমার বিশেষ কোনও আপত্তি নাই।”

 তনু রায়ের স্ত্রী সেই কথা খেতুর মাকে বলিলেন। খেতুর মা সেই কথা খেতুকে বলিলেন। এবার যখন খেতু বাড়ী আসিলেন, তখন কঙ্কাবতীর জন্য একখানি প্রথমভাগ বর্ণপরিচয় আনিলেন। “লেখাপড়া শিখিব”, এই কথা মনে করিয়া প্রথম প্রথম কঙ্কাবতীর খুব আহ্লাদ হইল।

 কিন্তু দুই-চারিদিন পরেই তিনি জানিতে পারিলেন যে, লেখাপড়া শিক্ষা করা নিতান্ত আমোদের কথা নহে। কঙ্কাবতীর চক্ষে অক্ষরগুলি সব একপ্রকার দেখায়। কঙ্কাবতী এটি বলিতে সেটি বলিয়া ফেলেন।

 খেতুর রাগ হইল। খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! তোমার লেখাপড়া হইবে না। চিরকাল তুমি মূর্খ হইয়া থাকিবে।”

 কঙ্কাবতী অভিমানে কাঁদিয়া ফেলিলেন। তিনি বলিলেন,— “আমি কি করিব, আমার যে মনে থাকে না?”

 খেতুর মা বলিলেন,— “ছেলেমানুষকে কি বকিতে আছে? মিষ্টকথা বলিয়া শিখাইতে হয়! এস, মা! তুমি আমার কাছে এস! তোমার আর লেখাপড়া শিখিতে হইবে না।”

২২
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ