পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করিয়াছিলেন। সেই অবধি বড় কন্যার সহিত তাঁহার আর কথাবার্ত্তা নাই।

 জনার্দ্দন চৌধুরীকে কন্যা দিতে তনু রায়ও প্রথমে ইতস্ততঃ করিয়াছিলেন। কিন্তু যখন জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন যে,— “আমার নববিবাহিতা স্ত্রীকে আমি দশ হাজার টাকার কোম্পানীর কাগজ দিব, একখানি তালুক দিব, স্ত্রী গা সোনা দিয়া মুড়িব, আর কন্যার পিতাকে দুই হাজার টাকা নগদ দিব।” তখন তনু রায় আর লোভ সংবরণ করিতে পারিলেন না।

 কঙ্কাবতীর মুখপানে চাহিয়া তবুও তনু রায় ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। কিন্তু তাহার পুত্র টাকার কথা শুনিয়া, একেবারে উন্মত্ত হইয়া পড়িলেন। বকিয়া-ঝকিয়া পিতাকে তিনি সম্মত করিলেন। টাকার লোভে এক্ষণে পিতাপুত্র দুই জনেই উন্মত্ত হইয়াছেন।

 তবুও তনু রায় স্ত্রীর নিকট নিজে একথা বলিতে সাহস করেন নাই। তাঁহার পুত্র বলিলেন,— “তোমাকে বলিতে হইবে না, আমি গিয়া মাকে বলিতেছি।”

 এই কথা বলিয়া পুত্র মা'র নিকট যাইলেন। মাকে বলিলেন,— “মা! জনার্দ্দন চৌধুরীর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ হইবে। বাবা সব স্থির করিয়া আসিয়াছেন।”

 মা'র মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল! মা বলিলেন,— “সে কি রে? ওরে, সে কি কথা! ওরে, জনার্দ্দন চৌধুরী যে তেকেলে বুড়ো! তার যে বয়সের গাছপাথর নাই! তার সঙ্গে কঙ্কাবতীর বিবাহ হবে কি রে?”

 পুত্র উত্তর করিলেন,— “বুড়ো নয় তা কি যুবো? না সে খোকা? জনার্দ্দন চৌধুরী তুলো করিয়া দুখ খায় না কি? না ঝুমঝুমি নিয়ে খেলা করে? মা যেন ঠিক পাগল! মা’র বুদ্ধি-সুদ্ধি একেবারে নাই। কঙ্কাবতীকে দশ হাজার টাকা দিয়া যেখানে যা ধরে গহনা দিবে, তালুক-মুলুক দিবে, বাবাকে দুই হাজার টাকা নগদ দিবে, আবার চাই কি? বুড়ো মরিয়া যাইলে, কঙ্কাবতীর টাকা গহনা সব আমাদের হইবে। থুড়থুড়ে বুড়ো বলিয়াই তো আহ্লাদের কথা। শক্তিসামর্থ্য থাকিলে এখন কত দিন বাঁচিত, তার ঠিক কি? মা! তোমার কিছুমাত্র বিবেচনা নাই।”

 এ কথার উপর আর কথা নাই। মা একেবারে বসিয়া পড়িলেন। অবিরল ধারায় তাহার চক্ষু হইতে অশ্রু বিগলিত হইতে লাগিল। মনে করিলেন যে,— “হে পৃথিবী! তুমি দুই ফাঁক হও, তোমার ভিতর আমি প্রবেশ করি।” মেয়ে দুইটিও অনেক কাঁদিলেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। কঙ্কাবতী নীরব। প্রাণ যাহার ধূ-ধূ করিয়া পুড়িতেছে, চক্ষে তাহার জল কোথা হইতে আসিবে?

 মা ও প্রতিবেশীদিগের নিকট হইতে খেতু এই সকল কথা শুনিলেন।

 খেতু প্রথম তনু রায়ের নিকট যাইলেন। তনু রায়কে অনেক বুঝাইলেন। খেতু বলিলেন,— “মহাশয়! এরূপ অশীতিপর বৃদ্ধের সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবেন না। আমার সহিত বিবাহ না হয় না দিবেন, কিন্তু একটি সুপাত্রের হাতে দিন। মহাশয় যদি সুপাত্রের অনুসন্ধান করিতে না পারেন, আমি করিয়া দিব।”

 এই কথা শুনিয়া তনু রায় ও তনু রায়ের পুত্র খেতুর উপর অতিশয় রাগান্বিত হইলেন। নানারূপ ভর্ৎসনা করিয়া তাঁহাকে বাটী হইতে তাড়াইয়া দিলেন।

 নিরঞ্জনকে সঙ্গে করিয়া খেতু তাহার পর জনার্দ্দন চৌধুরীর নিকট গমন করিলেন। হাতযোড় করিয়া অতি বিনীতভাবে জনার্দ্দন চৌধুরীকে বিবাহ করিতে নিষেধ করিলেন। প্রথমতঃ জনার্দ্দন চৌধুরী সে কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। তাহার পর খেতু যখন তাঁহাকে দুই-একবার বৃদ্ধ বলিলেন, তখন রাগে তাঁহার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল। তাঁহার শ্লেষ্মার

৩৪
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ