পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 গোবৰ্দ্ধন শিরোমণিকে সম্বোধন করিয়া গদাধর বলিল,— “শিরোমণি মহাশয়! সেই গরদওয়ালা ব্রাহ্মণের কথা গো।”

 শিরোমণি বলিলেন,— “সে বাজে কথা। সে কথা আর তোমাকে বলিতে হইবে না।”

 জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— “না না, খেতার সহিত তোমার কি কথা হইয়াছিল, আমি সকল কথা শুনিতে ইচ্ছা করি। গরদওয়ালা ব্রাহ্মণের কথা আমি অল্প অল্প শুনিয়াছিলাম, গ্রামের সকলেই সে কথা জানে। তবে খেতা তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করিল, আর তুমি কি বলিলে, সে কথা আমি জানিতে ইচ্ছা করি।”

 গদাধর বলিতেছে,— “তাহার পর খেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, — 'গদাধর! আমাদের মাঠে সেকালে না কি মানুষ মারা হইত? আর তুমি না কি সেই কাজের একজন সর্দ্দার ছিলে?' আমি উত্তর করিলাম,— 'দাদাঠাকুর! উচঙ্কা বয়সে কোথায় কি করিয়াছি, কি না করিয়াছি, সে কথায় এখন আর কাজ কি? এখন তো আর সেসব নাই? এখন কোম্পানীর কড়া হুকুম।' খেতু বলিলেন,— 'তা বটে, তবে সেকালের ঠেঙ্গাড়েদের কথা আমার শুনিতে ইচ্ছা হয়। তুমি নিজে হাতে এসব করিয়াছ, তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। তোমরা দুই-চারি জন যা বৃদ্ধ আছ, মরিয়া গেলে, আর এসব কথা শুনিতে পাইব না। আর দেখ, গ্রামের সকলেই তো জানে যে, তুমি এ কাজের একজন সর্দ্দার ছিলে!' আমি বলিলাম,— 'না দাদাঠাকুর। আপনারা থাকিতে আমরা কি কোনও কাজের সর্দ্দার হইতে পারি? আপনারা ব্রাহ্মণ, আমাদের দেবতা! সকল কাজের সর্দ্দার আপনারা।' তাহার পর খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'তবে তোমাদের দলের সর্দ্দার কে ছিলেন?' আমি বলিলাম,— 'আজ্ঞা! আমাদের দলের সর্দ্দার ছিলেন, কমল ভট্টাচার্য্য মহাশয়! এক সঙ্গে কাজ করিতাম বলিয়া তাঁহাকে আমরা কমল কমল বলিয়া ডাকিতাম। তিনি এক্ষণে মরিয়া গিয়াছেন।' খেতু তাহার পর জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'গদাধর! তোমরা কখনও ব্রাহ্মণ মারিয়াছ?' আমি বলিলাম,— 'আজ্ঞা, মাঠের মাঝখানে যারে পাইতাম, তাহাকেই মারিতাম। তাহাতে কোনও দোষ নাই। পরিচয় লইয়া মাথায় লাঠি মারিতে গেলে আর কাজ চলে না। পথিকের কাছে কি আছে না আছে, সে কথা জিজ্ঞাসা করিয়াও মারিতে গেলে চলে না। প্রথমে মারিয়া ফেলিতে হইত। তাহার পর গলায় পৈতা থাকিলে জানিতে পারিতাম যে, সে লোকটি ব্রাহ্মণ, না থাকিলে বুঝিতাম যে, সে শূদ্র। আর প্রাপ্তির বিষয় যেদিন যেরূপ অদৃষ্ট থাকিত, সেইদিন সেইরূপ হইত। কত হতভাগা পথিককে মারিয়া শেষে একটি পয়সাও পাই নাই। ট্যাকে, কাচায়, কোঁচায় খুঁজিয়া একটি পয়সাও বাহির হয় নাই। সে বেটারা জুয়াচোর, দুষ্ট, বজ্জাৎ। পথ চলিবে বাপু, টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়া চল। তা না শুধু হাতে! বেটাদের কি অন্যায় বলুন দেখি, দাদাঠাকুর? একটি মানুষ মারিতে কি কম পরিশ্রম হয়? খালিহাতে রাস্তা চলিয়া আমাদের সব পরিশ্রম বেটারা নষ্ট করিত।' খেতু আমাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'হাঁ গদাধর! মানুষের প্রাণ কি সহজে বাহির হয় না?' আমি বলিলাম,— 'সকলের প্রাণ সমান নয়। কেহ বা লাঠি খাইতে না খাইতে উদ্দেশে মরিয়া যায়। কেহ বা ঠুশ করিয়া একঘা খাইয়াই মরিয়া যায়। আর কাহাকেও বা তিন-চারি জনে পড়িয়া পঞ্চাশ লাঠিতেও মারিতে পারা যায় না। একবার একজন ব্রাহ্মণকে মারিতে বড়ই কষ্ট হইয়াছিল।' খেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'কি হইয়াছিল?”

 গোবৰ্দ্ধন শিরোমণির পানে চাহিয়া গদাধর বলিল,— “শিরোমণি মহাশয়! সেই কথা গো!”

 শিরোমণি বলিলেন,— “চৌধুরী মহাশয়! আপনার আর ওসব পাপ কথা শুনিয়া কাজ নাই। এক্ষণে ক্ষেত্রচন্দ্রকে লইয়া কি করা যায়, আসুন, তাহার বিচার করি। সাহেবের জল পান করিয়া অবশ্যই তিনি সাহেবত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই!”

কঙ্কাবতী
৩৭