পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আপনার দুই হাত দিয়া ব্রাহ্মণের দুটি হাত ধরিয়া মাটিতে চাপিয়া রাখিয়াছেন, কমলের বাম পা মাটিতে রহিয়াছে, দক্ষিণ পা ব্রাহ্মণের উদরে, এই পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ঘোরতর বলের সহিত ব্রাহ্মণের নাভির ভিতর প্রবেশ করাইতেছেন। পড়িয়া পড়িয়া ব্রাহ্মণ চীৎকার করিতেছেন। কমল আমাকে বলিলেন,— 'এ বামুন বেটা কি বজ্জাৎ! বেটা যে মরে না হে! গদাধর! শীঘ্র একটা যা-হয় কর। তা না হইলে বেটার চীৎকারে লোক আসিয়া পড়িবে। আমার হাতে তখন লাঠি ছিল না, নিকটে একখান পাথর পড়িয়ছিল। সেই পাথরখানি লইয়া আমি ব্রাহ্মণের মাথাটি ছেঁচিয়া দিলাম। তবে ব্রাহ্মণের প্রাণ বাহির হইল। যাহা হউক, এই ব্রাহ্মণকে মারিতে পরিশ্রম হইয়াছিল বটে, কিন্তু সেবার লাভও বিলক্ষণ হইয়াছিল। অনেকগুলি টাকা আর অনেক গরদের কাপড় আমরা পাইয়াছিলাম। কি করিয়া নশিরাম সর্দ্দার এই কথা শুনিতে পাইয়াছিলেন। নশিরাম ভাগ চাহিলেন। আমরা বলিলাম,— 'এ কাজে তোমাকে কিছু করিতে হয় নাই, তোমাকে আমরা ভাগ দিব কেন?' কথায় কথায় কমলের সহিত নশিরামের ঘোরতর বিবাদ বাধিয়া উঠিল; ক্রমে মারামারি হইবার উপক্রম হইল। কমল পৈতা ছিড়িয়া নশিরামকে শাপ দিলেন। কমল ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ। সাক্ষাৎ অগ্নিস্বরূপ! শিষ্য-যজমান আছে। সেরূপ ব্রাহ্মণের অভিশাপ ব্যর্থ হইবার নহে। পাঁচ-সাত বৎসরের মধ্যেই মুখে রক্ত উঠিয়া নিশিরাম মরিয়া গেল। যাহা হউক, সেইসব কাপড় হইতে একেজোড়া ভাল গারদের কাপড় আমরা শিরোমণি মহাশয়কে দিয়াছিলাম। যখন সেই গরদের কাপড়খানি পরিয়া, দোবজটি কাঁধে ফেলিয়া, ফোঁটাটি কাটিয়া, শিরোমণি মহাশয় পথে যাইতেন, তখন সকলে বলিত,— 'আহা! যেন কন্দৰ্পপুরুষ বাহির হইয়াছেন!’ বয়সকালে মহাশয়ের রূপ দেখে কে? না, শিরোমণি মহাশয়?”

 শিরোমণি মহাশয় বলিলেন,— “গদাধর! গদাধর! তোমার এরূপ বাক্য বলা উচিত নয়। তুমি যাহা বলিতেছ, তাহার আমি কিছুই জানি না। পীড়া-শীড়ায় তোমার বুদ্ধি লোপ হইয়াছে, আমি তোমার জন্য নারায়ণকে তুলসী দিব। তাহা হইলে তোমার পাপক্ষয় হইবে।”

 নিরঞ্জন এই সমুদয় বৃত্তান্ত শুনিতেছিলেন, মাঝে মাঝে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতেছিলেন, আর বলিতেছিলেন,— “হা মধুসূদন! হা দীনবন্ধু!”

 জনার্দ্দন চৌধুরী কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাঁহার পর কি হইল গদাধৱ?”

 গদাধর উত্তর করিল,— “তাহার পর আর কিছু হয় নাই। খেতু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, অন্যমনস্কভাবে আমাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'একটু বরফ খাবে গদাধর?' আমি বলিলাম,— 'না দাদাঠাকুর! আমি বরফ খাইব না, বরফ খাইলে আমার অধর্ম্ম হইবে, আমার জাতি যাইবে।”

 জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— “তবে তুমি নিশ্চয় বলিতেছ যে, খেতু বরফ খাইয়াছে?”

 গদাধর উত্তর করিল,— “আজ্ঞা হাঁ, ধর্ম্মাবতার! আমি তাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। আপনি ব্রাহ্মণ! আপনার পায়ে হাত দিয়া আমি দিব্য করিতে পারি।”

কঙ্কাবতী
৩৯