পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,_ “কষ্কাবতীর বিবাহ হইবে না? আচ্ছা, সে ভাবনা আমি ভাবিব। কিন্তু তোমার তো প্রকৃত সে চিন্তা নয়? তোমার চিন্তা যে, জনার্দ্দন চৌধুরীর টাকাগুলি হাত-ছাড়া হইল। যাহা হউক, তোমার গলগ্রহ হইয়া আমরা থাকিব না। যেখানে আমাদের দুচক্ষু যায়, আমরা চারিজনে সেইখানে যাইব। মেয়ে তিনটির হাত ধরিয়া দ্বারে দ্বারে আমি ভিক্ষা করিব।”

 স্ত্রীর এইরূপ উগ্রমূর্ত্তি দেখিয়া অনুরায় ভাবিলেন,— “ঘোর বিপদ!” নানারূপ মিষ্টবচন বলিয়া স্ত্রীকে সাত্ত্বনা করিতে লাগিলেন। স্ত্রীর অনেকটা রাগ পড়িয়া আসিলে, শেষে তনু রায় বলিলেন,— “দেখ! পাগলের মত কথা বলিও না। যাও, বাড়ীর ভিতর যাও। যাও, মা, কঙ্কাবতী বাড়ীর ভিতর যাও।”

 মা, কঙ্কাবতী ও ভগিনী দুইটি বাটীর ভিতর যাইলেন। কঙ্কাবতী পুনরায় বাপ-মা'র নিকট রহিলেন। বাটী পরিত্যাগ করিয়া যাহা যাহা ঘটনা হইয়াছিল, আদ্যোপান্ত সমুদয় কথা কঙ্কাবতী মাকে বলিলেন,— কঙ্কাবতী নিজে, কি কঙ্কাবতীর মা, এ সমুদয় কথা অন্য কাহাকেও কিছু বলিলেন না।

 কঙ্কাবতীকে তনু রায় সর্ব্বদাই ভর্ৎসনা করেন, সর্ব্বদাই গঞ্জনা দেন। কঙ্কাবতী সে কথায় কোনও উত্তর করেন না, আধোবদনে চুপ করিয়া শুনেন।

 তনু রায় বলেন,— “এমন রাজ হেন পাত্রের সহিত তোমার বিবাহ স্থির করিলাম। তোমার কপালে সুখ নাই, তা আমি কি করিব? জনার্দ্দন চৌধুরীকে কত বুঝাইয়া বলিলাম, কিন্তু তিনি আর বিবাহ করিবেন না। এখন এ কন্যা লইয়া আমি করি কি? পঞ্চাশ টাকা দিয়াও কেহ এখন ইহাকে বিবাহ করিতে চায় না।”

 স্ত্রী-পুরুষে, মাঝে মাঝে এই কথা লইয়া বিবাদ হয়। স্ত্রী বলেন,— “কঙ্কাবতীর বিবাহের জন্য তোমাকে কোনও চিন্তা করিতে হইবে না। একবৎসরকাল চুপ করিয়া থাক। কঙ্কাবতীর বিবাহ আমি নিজে দিব। যদি আমার কথা না শোন, যদি অধিক বাড়াবাড়ি কর, তাহা হইলে মেয়ে তিনটির হাত ধরিয়া তোমার বাটী হইতে চলিয়া যাইব।”

 তনু রায় বৃদ্ধ হইয়াছেন। স্ত্রীকে এখন তিনি ভয় করেন, এখন স্ত্রীকে যা-ইচ্ছা বলিতে বড় সাহস করেন না।

 এইরূপে দেখিতে দেখিতে একবৎসর কাটিয়া গেল। খেতুর দেখা নাই, খেতুর কোনও সংবাদ নাই, কঙ্কাবতীর মুখ মলিন হইতে মলিনতর হইতে লাগিল, কঙ্কাবতীর মা'র মনে ঘোর চিন্তার উদয় হইল। কঙ্কাবতীর বিবাহ-বিষয়ে স্বামী কোনও কথা বলিলে এখন আর তিনি পূর্ব্বের ন্যায় দম্ভের সহিত উত্তর করিতে সাহস করেন না। বৎসর শেষ হইয়া যতই দিন গত হইতে লাগিল, তনু রায়ের তিরস্কার ততই বাড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতীর মা অপ্রতিভ হইয়া থাকেন, বিশেষ কোনও উত্তর দিতে পারেন না।

 একদিন সন্ধ্যার পর তনু রায় বলিলেন,— “এতবড় মেয়ে হইল, এখন এ মেয়ে লইয়া আমি করি কি? সুপাত্র ছাড়িয়া কুপাত্র মিলাও দুর্ঘট হইল।”

 কঙ্কাবতীর মা উত্তর করিলেন,— “আজ একবৎসর অপেক্ষা করিলে, আর অল্পদিন অপেক্ষা কর। সুপাত্র শীঘ্রই মিলিবে।”

 তনু রায় বলিলেন,— “একবৎসর ধরিয়া তুমি এই কথা বলিতেছ। কোথা হইতে তোমার সুপাত্র আসিবে, তাহা বুঝিতে পারি না। তোমার কথা শুনিয়া আমি এই বিপদে পড়িলাম। সেদিন যদি কুলাঙ্গারীকে দূর করিয়া দিতাম, তাহা হইলে আজ আর আমাকে এ বিপদে পড়িতে হইত না। এখন দেখিতেছি, সেকালের রাজারা যা করিতেন, আমাকেও তাই করিতে হইবে। ব্রাহ্মণ না হয়, চণ্ডালের সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইবে। মনুষ্য না হয়, জীবজন্তুর সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইবে। রাগে আমার সর্ব্বশরীর জ্বলিয়া যাইতেছে। আমি সত্য বলিতেছি,

কঙ্কাবতী
৫৯