পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 বর না চোর! ব্যাঘ্র, ঘাড় হেঁট করিয়া রহিলেন। বাসরঘরে গান গাহিয়াছিলেন কি না, সেকথা শালী-শালাজ ঠানদিদিরা বলিতে পারে। আমরা কি করিয়া জানিব?

 প্রভাত হইবার পূর্ব্বে ব্যাঘ্র তনু রায়কে বলিলেন,— “মহাশয়! রাত্রি থাকিতে থাকিতে জনসমাজ পরিত্যাগ করিয়া বনে আমাকে পুনরাগমন করিতে হইবে। অতএব আপনার কন্যাকে সুসজ্জিতা করিয়া আমার সহিত পাঠাইয়া দিন! আর বিলম্ব করিবেন না।”

 প্রতিবাসিনীগণ কঙ্কাবতীর চুল বাঁধিয়া দিলেন। কঙ্কাবতীর মাতা কঙ্কাবতীর ভাল কাপড়গুলি বাছিয়া বাছিয়া বাহির করিলেন।

 তাহা দেখিয়া তনু রায় রাগে আরক্ত-নয়নে স্ত্রীকে বলিলেন,— “তোমার মত নির্ব্বোধ আর এ পৃথিবীতে নাই। যাহার ঘরে এরূপ লক্ষ্মী-ছাড়া স্ত্রী, তাহার কি কখনও ভাল হয়? ভাল বল দেখি? বাঘের কিসের অভাব? কাপড়ের দোকানে গিয়া হালুম করিয়া পড়িবে, দোকানী দোকান ফেলিয়া পলাইবে, আর বাঘ কাপড়ের গাঠরি লইয়া চলিয়া যাইবে! স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে গিয়া বাঘ হালুম করিয়া পড়িবে, প্রাণের দায়ে স্বর্ণকার পলাইবে, আর বাঘ গহনাগুলি লইয়া চলিয়া যাইবে। দেখিয়া-শুনিয়া যখন এরূপ সুপাত্রের হাতে কন্যা দিলাম, তখন আবার কঙ্কাবতীর সঙ্গে ভাল কাপড়-চোপড় দেওয়া কেন? তাই বলি, তোমার মত বোকা আর এ ভূ-ভারতে নাই।”

 তনু রায় লক্ষ্মীমন্ত পুরুষ, বৃথা অপব্যয় একেবারে দেখিতে পারেন না। যখন তাঁহার মাতার ঈশ্বর-প্রাপ্তি হয়, তখন মাতা বিছানায় শুইয়াছিলেন। নাভিশ্বাস উপস্থিত হইলে, মাকে তিনি কেবলমাত্র একখানি ছেঁড়া মাদুরে শয়ন করাইলেন। নিতান্ত পুরাতন নয়, এরূপ একখানি বস্তু তখন তাহার মাতা পরিয়াছিলেন। কণ্ঠ-শ্বাস উপস্থিত হইলে, সেই বস্ত্রখানি তনু রায় খুলিয়া লইলেন। আর একখানি জীর্ণ ছিন্ন গলিত নেকড়া পরাইয়া দিলেন। এরূপ টানা-হেঁচড়া করিতে ব্যস্ত থাকা প্রযুক্ত, মৃত্যু-সময়ে তিনি মাতার মুখে একবিন্দু জল দিতে অবসর পান নাই। কাপড় ছাড়াইয়া, ভক্তিভাবে, যখন পুনরায় মাকে শয়ন করাইলেন, তখন দেখিলেন, যে মা অনেকক্ষণ হইয়া গিয়াছে।

 স্বামীর তিরস্কারে, তনু রায়ের স্ত্রী, দুই-একখানি ছেঁড়া-খোঁড়া নেকড়া-চোকড়া লইয়া একটি পুঁটুলী বাঁধিলেন। সেইটি কঙ্কবতীর হাতে দিয়া, কাঁদিতে কাঁদিতে, ঠাকুরদের ডাকিতে ডাকিতে, কন্যাকে বিদায় করিলেন।


সপ্তম পরিচ্ছেদ

বনে

পুঁটলী হাতে করিয়া কঙ্কাবতী ব্যাঘ্রের নিকট আসিয়া অধোবদনে দাঁড়াইলেন। ব্যাঘ্র মধুরভাষে বলিলেন, — “কঙ্কাবতী! তুমি বালিকা! পথ চলিতে পরিবে না। তুমি আমার পৃষ্ঠে আরোহণ কর, আমি তোমাকে লইয়া যাই। তাহাতে আমার কিছুমাত্র ক্লেশ হইবে না।”

 কঙ্কাবতী গাছ-কোমর বাঁধিয়া বাঘের পিঠের উপর চড়িয়া বসিলেন। ব্যাঘ্র বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! আমার পিঠের লোম তুমি দৃঢ় রূপে ধরা। দেখিও, যেন পড়িয়া যাইও না।”

 কঙ্কাবতী তাহাই করিলেন। ব্যাঘ্র বনাভিমুখে দ্রুতবেগে ছুটিলেন। বিজন অরণ্যের মাঝখানে উপস্থিত হইয়া ব্যাঘ্র জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কঙ্কাবতী! তোমার কি ভয় করিতেছে?”

৬২
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ