পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তোমার আমি খাবার ঠিক করিয়া দিতেছি। এই গ্রামে এক গোয়ালিনী আছে। মাগী বড় দুষ্ট! দু'বেলা আসিয়া আমার সঙ্গে ঝগড়া করে। তোমাকে কন্যা দিয়াছি বলিয়া মাগী আমাকে যা নয় তাই বলে। মাগী আমাকে বলে,— 'অল্পায়ু, বুড়ো, ডেকরা। টাকা নিয়ে কি না বাঘকে মেয়ে বেচে খেলি!' তুমি আমার জামাতা, ইহার একটা প্রতিকার তোমাকে করিতে হইবে। তুমি তার ঘাড়টি ভাঙ্গিয়া রক্ত খাও। তার রক্ত ভাল, খাইয়া তৃপ্তিলাভ করিবে।”

 ব্যাঘ বলিল,— “না মহাশয় আজ আমি কিছু খাইতে পারিব না, আজ ক্ষুধা নাই।”

 তনু রায় ভাবিলেন,— “জামাতারা কিছু লজ্জাশীল হন। বারবার ‘খাও খাও’ বলিতে হয়, তবে কিছু খান। খাইতে বসিয়া ‘এটি খাও, ওটি খাও, আর একটু খাও' এইরূপে পাঁচজনে বারবার না বলিলে, জামাতারা পেট ভরিয়া আহার করেন না। পাতে সব ফেলিয়া উঠিয়া যান। এদিকে জঠরানল দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতে থাকে, ওদিকে মুখে বলেন,— 'আর ক্ষুধা নাই, আর খাইতে পারি না।' জামাতাদিগের রীতি এই।”

 এইরূপ চিন্তা করিয়া, তনু রায় আবার বলিলেন,— “শ্বশুরবাড়ী আসিয়া কিছু না খাওয়া কি ভাল? লোকে আমার নিন্দা করিবে। পাড়ার লোকগুলির কথা তোমাকে আর কি পরিচয় দিব! পাড়ার মেয়ে-পুরুষগুলি এক একটি সব অবতার! তামাসা দেখিতে খুব প্রস্তুত। পরের ভাল একটু দেখিতে পারেন না। তুমি আমার জামাতা হইয়াছ, যাহা হউক, তোমার দু’পয়সা সঙ্গতি আছে, এই হিংসায় সকলে ফাটিয়া মরিতেছেন। এখনি কা’ল সকালে বলিবেন যে, তনু রায়ের জামাতা আসিয়াছিল, 'তনু রায় জামাতার কিছুমাত্র আদর করে নাই, একফোঁটা জল পর্য্যন্ত খাইতে দেয় নাই।' সেইজন্য কিছু খাইতে তোমাকে বারবার অনুরোধ করিতেছি। চল, গোয়ালিনীর ঘর তোমাকে দেখাইয়া দিই। সে দুধ-ঘি খায়? মাংস তাহার কোমল। তাহার মাংস তোমার মুখে ভাল লাগিবে। খাইয়া তৃপ্তিলাভ করিবে। মন্দ দ্রব্য কি তোমাকে খাইতে বলিতে পারি?”

 ব্যাঘ্র উত্তর করিল,— “এবার আমাকে ক্ষমা করুন। এইবার যখন আসিব, তখন দেখা যাইবে।”

 তনু রায় মনে মনে কিছু ক্ষুন্ন হইলেন। জামাতা আদরের সামগ্রী। প্রাণ ভরিয়া আদর করিতে না পারিলে শ্বশুর-শাশুড়ীর মনে ক্লেশ হয়। তিনি তিনটি সুখাদ্যের কথা বলিলেন, জামাতা কিন্তু একটিও খাইলেন না। তাহাতে ক্ষুন্ন হইবার কথা।

 তনু রায় বলিলেন,— “শ্বশুরবাড়ীতে এরূপ খাইয়া-দাইয়া আসিতে নাই। শ্বশুর-শাশুড়ীর মন তাহাতে বুঝিবে কেন? জামাতা কিছু না খাইলে শ্বশুর-শাশুড়ীর মনে দুঃখ হয়। এই আজ তুমি কিছু খাইলে না, সেজন্য তোমার শাশুড়ীঠাকুরাণী আমাকে কত বকিবেন। তিনি বলিবেন,— 'তুমি জামাতাকে ভাল করিয়া বল নাই, তাই জামাতা আহার করিলেন না।' আবার যখন আসিবে, তখন আহারাদি করিয়া এস না। এইখানে আসিয়া আহার করিবে। তোমার জন্য এই তিনটি খাদ্যসামগ্রী আমি ঠিক করিয়া রাখিলাম। এবার আসিয়া একেবারেই তিনটিকে খাইতে হইবে। যদি না খাও, তাহা হইলে বনে যাইতে দিব না, তোমার চাদর ও ছাতি লুকাইয়া রাখিব। না না! ও কথা নয়; তোমার যে আবার ছাতি কি চাদর নাই। যদি না খাও, তাহা হইলে তোমার উপর আমি রাগ করিব।”

 কঙ্কাবতী, সমস্ত রাত্রি মা ও ভগিনীদিগের সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে লাগিলেন। ব্যাঘ্র প্রকৃত কে, তাহা মাতাকে বলিলেন। আর দুই মাস পরে তাঁহারা যে বিপুল ঐশ্বর্য্য লইয়া দেশে আসিবেন, তাহাও মাতাকে বলিলেন।

কঙ্কাবতী
৬৭