পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কারণ না হয়, পরের অত্যাচারে সে প্রপীড়িত হইতে পারে। আমি হয়ত পরের অত্যাচার হইতে তাহাকে রক্ষা করিতে অসমর্থ। নিরুপায় হইয়া প্রাণসম সেই প্রিয় বস্তুর যাতনা আমাকে দেখিতে হয়। এই ধর,— যেমন তোমার প্রতি পিতা-ভ্রাতার পীড়ন; তাহার আমি কি করিতে পারিয়াছিলাম? চারিদিকে সাধুদিগের ধুনী দেখিয়া তখন আমার মনে এইরূপ ভাবের উদয় হইয়াছিল। আবার ভাবিলাম,— এই সংসার-ক্ষেত্র প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্র! নানা পাপ, নানা দুঃখ, এই সংসারে অহরহ বিচরণ করিতেছে। কোটি কোটি প্রাণী সেই পাপে, সেই তাপে তাপিত হইয়া সংসার-যাতনা ভোগ করিতেছে। আমি-যা’র জ্ঞান-চক্ষু তাঁহাদের চেয়ে অনেক পরিমাণে উন্মীলিত হইয়াছে, পাপ-তাপের সহিত যুদ্ধ করিতে যে অধিকতর সুসজ্জিত হইয়াছে, আমি কি সে যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হইব? জগতের হিতের নিমিত্ত অহিতের সহিত যুদ্ধ না করিয়া কাপুরুষের ন্যায় পরাজয় মানিয়া, নিৰ্জ্জন গভীর কাননে গিয়া বসিয়া থাকিব? কঙ্কাবতী! এইরূপ কত কি যে ভাবিলাম, তাহা আর তোমাকে কি বলিব!”

 “আস্তে আস্তে পুনরায় জল লইয়া বাটী প্রত্যাগমন করিলাম। এইরূপে একবৎসর গত হইল। এই সময়ের মধ্যে প্রায় দুই সহস্র টাকা সঞ্চয় করিয়াছিলাম। মনে করিলাম, —এই টাকা পাইলে, তোমার পিতা পরিতোষ লাভ করিবেন। তোমাকে আমি পাইব। টাকাগুলি লইয়া দেশাভিমুখে যাত্রা করিলাম। সমুদয় নগদ টাকা ছিল, নোট লই নাই; কারণ, নোটের প্রতি আমাদের গ্রামের লোকের আস্থা নাই। একটি ব্যাগের ভিতর টাকাগুলি লইয়া রেলগাড়ীতে চড়িলাম। ব্যাগটি আপনার কাছে অতি যত্নে অতি সাবধানে রাখিলাম। পাছে কেন চুরি করে, পাছে কেন লয়, এই ভয়ে একবারও গাড়ী হইতে নামি নাই। যখন সন্ধ্যা হইল, তখন বড় একটি ষ্টেশনে আসিয়া গাড়ী থামিল। সেখানে অনেকক্ষণ পর্যন্ত গাড়ী দাঁড়াইবে। আমার বড় ক্ষুধা পাইয়াছিল। তবুও জলখাবার কিনিবার জন্য গাড়ী হইতে আমি নামিলাম না। যে গাড়িতে আমি বসিয়াছিলাম, সে গাড়ীতে আর একটি অপরিচিত লোক ছিল, অন্য আর কেহ ছিল না। সে লোকটি লোকটি নিজের জন্য জলখাবার আনিতে গেল। যাইবার সময় সে আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,— 'মহাশয়! আপনার যদি কিছু প্রয়োজন থাকে তো বলুন, আমি আনিয়া দিই।' আমি উত্তর করিলাম,— 'যদি তুমি আনিয়া দাও, তাহা হইলে আমি উপকৃত হইব।' এই বলিয়া, জলখাবার কিনিবার নিমিত্ত তাহাকে আমি পয়সা দিলাম। সে আমাকে জলখাবার আনিয়া দিল। আমি তাহা খাইলাম। অল্পক্ষণ পরে আমার মাথা ঘুরিতে লাগিল। মনে করিলাম, 'গাড়ীর উত্তাপে এইরূপ হইয়াছে।' একটু শুইলাম। শুইতে না শুইতে ঘোর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলাম। চৈতন্য কিছুমাত্র রহিল না। প্রাতঃকাল হইলে অল্পে অল্পে জ্ঞানের উদয় হইল। কিন্তু মাথা বড় ব্যথা করিতে লাগিল, মাথা যেন তুলিতে পারি না। যাহা হউক, জ্ঞান হইলে দেখি যে, শিয়রে আমার ব্যাগ নাই। চারিদিকে চাহিয়া দেখি যে, গাড়ীতে সে লোকটা নাই। আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত পড়িল। আস্তে-ব্যস্তে উঠিয়া গাড়ীর চারিদিক তন্ন-তন্ন করিয়া খুঁজিলাম। ব্যাগ নাই! ব্যাগ দেখিতে পাইলাম না। আমার যে ঘোর সর্ব্বনাস হইয়াছে, এখন তাহা নিশ্চয় বুঝিলাম। একবৎসর ধরিয়া, এত কষ্ট পাইয়া, জল খাইয়া যে টাকা আমি সঞ্চয় করিয়াছিলাম, আজ সে টাকা আমার নাই। কিরূপ মর্ম্মভেদী অসহ্য যাতনা আমার মনের ভিতর তখন হইল, একবার বুঝিয়া দেখ! কঙ্কাবতী! মানুষের মনে এরূপ নিষ্ঠুরতা কোথা হইতে আসিল? যদি এ নিষ্ঠুরতা নরক না হয়, তবে নরক আবার কি? কঙ্কাবতী! মানুষে মানুষকে এরূপ যাতনা দেয় কেন? পারকে যাতনা দিতে, তাদের কি ক্লেশ হয় না?”

 অনেকক্ষণ পরে কঙ্কাবতীর চক্ষুতে জল আসিল, কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিলেন। কঙ্কাবতী

কঙ্কাবতী
৭৫