পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একাদশ পরিচ্ছেদ

ভূত-কোম্পানী

খেতু বলিতেছেন,— “রাত্রি প্রায় দুই প্রহর হইয়াছে, অতিশয় শ্রান্তিবশতঃ আমার একটু নিদ্রার আবেশ হইয়া আসিতেছে, এমন সময় মন্দিরের সোপানে কি ঠক-ঠক করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। চাহিয়া দেখি না, ভীষণাকার শ্বেতবর্ণ এক মড়ার মাথা। একটি পৈঠা হইতে অন্য পৈঠার উপর লাফাইয়া লাফাইয়া উঠিতেছে। কঙ্কাবতি! ভয় আমার শরীরে কখনও নাই, তবুও এই মড়ার মাথার কাণ্ড দেখিয়া আমার শরীর কেমন একটু রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। আমি উঠিয়া বসিলাম। মড়ার মাথাটি লাফাইয়া সমস্ত পৈঠাগুলি উঠিল, তারপর ভাটার মত গড়াইতে গড়াইতে আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। আমার নিকট আসিয়া একটি লাফ মারিল, লাফ মারিয়া আমার ঠিক মুখের সম্মুখে শূন্যেতে স্থির হইয়া কিছুক্ষণের নিমিত্ত আমার দিকে চাহিয়া রহিল! সেইখানে থাকিয়া আকর্ণ হা করিয়া দন্তপাতি বাহির করিল।

 এইরূপ বিকটাকার হাঁ করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,— “বাবু! তুমি না কি ভূত মানো না?”

 আমি উত্তর করিলাম,— “রক্ষা করুন, মহাশয়! আপনারা পর্য্যন্ত আর আমার সহিত লাগিবেন না। নানা কষ্টে, নানা দুঃখে আমি বড়ই উৎপীড়িত হইয়াছি। যান, ঘরে যান! আমাকে আর জ্বালাতন করিবেন না।”

 আমার কথায় মুণ্ডটির আরও ক্রোধ হইল। চীৎকার করিয়া সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল,— “বাবু! তুমি নাকি ভূত মানো না? ইংরেজী পড়িয়া তুমি নাকি ভূত মানো না?”

 আমি বলিলাম,— “ইংরেজি-পড়া বাবুরা ভূত মানেন না বলিয়া কি আপনার রাগ হইয়াছে? লোকে ভূত না মানিলে কি আপনাদের অপমান বোধ হয়?”

 মড়ার মুণ্ড উত্তর করিল,— “রাষ্ট্র হইবে না তো কি, সর্ব্বশরীর শীতল হইবে? ভূত না মানিলে ভূতাদিগের অপমান হয় না তো কি আর মর্য্যাদা বাড়ে? কেন লোকে বলিবে যে, পৃথিবীতে ভূত নাই? ইংরেজি-পড়া বাবুদের আমরা কি করিয়াছি যে, তাহারা আমাদিগকে পৃথিবী হইতে একেবারে উড়াইয়া দিবে। দেবতাদিগকে তোমরা উড়াইয়া দিয়াছ, এখন এই উপদেবতা কয়টাকে শেষ করিতে পারিলেই হয়। বটে!”

 দুঃখের সময়ও হাসি পায়! দেবতাদিগকে না মানিলে, না পূজা দিলে, দেবতাদিগের রাগ হয়, দেবতারা মুখ হাঁড়ি করিয়া বসিয়া থাকেন, একথা পূর্ব্বে জানিতাম; কিন্তু লোকে ভূত না মানিলে, ভূতের রাগ হয়, ভূতের অপমান হয়, একথা কখনও শুনি নাই। আমার তাই হাসি পাইল।

 আমি বলিলাম,— “হাঁ মহাশয়! ইংরেজী-পড়া বাবুদের এটি অন্যায় বটে!”

 আমার কথায় মড়ার মাথা কিছু সন্তুষ্ট হইল, অনেকটা তাহার রাগ পড়িল। মুণ্ড বলিল,— “তুমি ছোকরা দেখিতেছি ভাল। ইংরেজি-পড়া বাবুদের মত ত্রিপণ্ড নাস্তিক নও! তোমার মাথায় টিকি আছে?”

 আমি বলিলাম,— “না মহাশয়! আমার মাথায় টিকি নাই।”

 মুণ্ড বলিল,— “এইবার ঘরে গিয়া টিকি রাখিও। আর শুন, ইংরেজি-পড়া বাবুদের আমরা সহজে ছাড়িব না। যাহাতে পুনরায় ভূতের উপর তাহাদিগের বিশ্বাস জন্মে, আমরা সে সমুদয়

৭৮
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ