পাতা:দৃষ্টিপ্রদীপ - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কিন্তু এখানে এসে পৰ্য্যন্ত দেখচি বাবার মত শান্ত মানুষটি আর পৃথিবীতে নেই। এত শান্ত, এত ভাল মানুষ স্নেহময় লোকটি মদ খেলে কি হয়েই যেতেন! চা-বাগানের সে-সব রাতের কীৰ্ত্তি মনে হলেও ভয় করে। , রবিবার। আমার স্কুল নেই, আমি সারাদিন বসে বসে ম্যাজেণ্টা গুলো রঙ তৈরি করেছি, দু-তিনটে শিশিতে ভক্তি করে রেখেছি, সীতার পাঁচ-ছখানা পুতুলের কাপড় রঙে ছুপিয়ে দিয়েছি-ক্লাসের একটা ছেলের কাছ থেকে অনেকখানি ম্যাজেণ্টার গুড়ো চেয়ে নিয়েছিলুম। 7 সন্ধ্যার একটু পরেই খেয়ে শুয়েচি। কত রাত্ৰে যেন ঘুম ভেঙে গেল-একটু অবাক হয়ে চেয়ে দেখি আমাদের ঘরের দোরে জ্যাঠাইমা আমার খুড়তুতো জাঠতুতো ভাইবোনের দল, ছোট কাকা-সবাই দাড়িয়ে । মা কঁাদচেন-সীতা বিছানায় সবে ঘুম ভেঙে উঠে বসে চোখ মুছছে। { আমার জাঠতুতো ভাই হেসে বললেন-ঐ দ্যাখ, তোর বাবা কি করাচে! চেয়ে দেখি ঘরের কোণে খাটে বাবা তিনটে বালিশের তুলে ছিড়ে পুটুলি বাধচোন। তুলোতে বাবার চোখমুখ, মাথার চুল, সারা গা এক অদ্ভুত রকম হয়েছে দেখতে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলুমকি হয়েছে বাবা ? বাবা বললেন-চা-বাগানে আবার চাকরি পেয়েছি।-ছোট সাহেব তার করেচে ; সকালের গাড়িতে যাব। কিনা তাই পুটুলিগুলো বেঁধেছেদে এখন না রাখলে-কটা বাজল রে খোকা ? আমার বয়স কম হলেও আমার বুঝতে দেরি হ’ল না ধে এবার বাবা মাতাল হননি। এ অন্য জিনিস। তার চেয়েও গুরুতর কিছু। ঘরের দৃশ্যটা আমার মনে চিরকালের মতো একটা |াপ দিয়ে দিয়েছিল-জীবনে কখনও ভুলিনি-চোখ বুজলেই উত্তৱজীবনে আবার সে-রাত্রির শুটা মনে এসেছে। একটা মাত্ৰ কেরোসিনের টেমি জলচে ঘরে-তারই রাঙা ক্ষীণ আলোয় রের কোণে বাবার তুলো-মাখা চেহারা-মাথায় মুখে কানে পিঠে সর্বাঙ্গে ছেড়া বালিশের লিচে। পুরানো বিচিওয়ালা তুলো, মেঝেতে বসে মা কঁাদচেন-দরজার কাছে কৌতুক দেখতে ড্রীমা জ্যাঠাইমারা জড় হয়েছেন-খুড়তুতো ভাই-বোনেরা হাসচে •••দাদাকে ঘরের মধ্যে খতে পেলাম না, বোধ হয় বাইরে কোথাও গিয়ে থাকবে। পরদিন সকালে আমাদের ঘরের সামনে উঠানে দলে দলে লোক জড় হ’তে লাগল। দেৱ মুখে শুনে প্ৰথম বুঝলাম বাবা পাগল হয়ে গিয়েছেন। সংসারের কষ্ট, মেয়ের বিয়ের বনা, পরের বাড়ির এই যন্ত্রণা--এই সব দিনরাত ভেবে ভেবে বাবার মাথা গিয়েছে। বিগড়ে । বিশিষ্ঠ এ-সব কারণ অনুমান করেছিলুম বড় হ’লে, অনেক পরে। বেলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকের ভিড় বাড়তে লাগল, যারা কোনো দিন। এর আগে বাবার মৌখিক ভদ্র আলাপটা করতেও আসেনি তারা মজা দেখতে আসতে লাগল দলে দলে ।