পাতা:দৃষ্টিপ্রদীপ - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছেলেমেয়েদের মাথায় শান্তিজাল ছিটিয়ে দিলেন। সবাই সাধ্যানুসারে কিছু কিছু দক্ষিণা দিলে পুরুতে ঠাকুরকে, তারপর নিজের নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে, নৈবিক্তির খালি থালা হাতে সবাই বাড়ি চলে গেল । কাছেই একটা পুকুর, পুরুতে ঠাকুর আমার হাতেও দুখানা বাতাসা ও ফুলবেলপাতা দিয়েছিলেন-বাতাসা দুখান খেয়ে পুকুরে জল খেলাম-ফুলবেলপাত পকেটে রেখে দিলাম। ছোট গ্রামখানা-দুরে রেলের লাইন, ভাঙা পুকুরের ঘাটটা নির্জন, চারিধারেই বড় বড় গাছে ঘেরা-শাস্ত, স্তন্ধ অপরাহ্ব-অনেক দিন পরে এই পূজোর ব্যাপারটা, বিশেষ ক’রে মেয়েদের মুখে একটা ভক্তির ভাব, পূজোর মধ্যে একটা অনাডম্বর সারল্য আমার 던 1 হাওড়া-পুল পার হয়েচি, এক জায়গায় একজন ভিখারিণী আধা-অন্ধকারের মধ্যে চেচিয়ে কার সঙ্গে ঝগড়া করচে আর কঁাদচে । কাছে গিয়ে দেখলাম ভিখারিণী অন্ধ, বেশ ফস। রং, হিন্দুস্থানী-বৃদ্ধ না হ’লেও প্রৌঢ় বটে। তার সামনে একখানা ময়লা ন্যাকড়া পাতাসেটাতে একটা পয়সাও নেই-গোটা-দুই টিনের কালো তোবড়া মগ, একটা ময়লা পুটুলি, একটা ভঁড়-এই নিয়ে তার কারবার । সে একটা সাত-আট বছরের মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া কৱচে-হিন্দীতে বলচে-তুই আমন ক’রে মারাবি কেন ? তোকে আমি ভিক্ষে ক’ৱে খাইয়ে এত বডটা করলাম। আর তুই আমাকেই মার দিতে শুরু করলি-আমার কপাল পোড়া, নইলে নিজের পেটের সন্তান এমন বন্দ হবে কেন ? দ্বাখ দেখি কি দিয়ে মারলি, কপালটা কেটে 〔究该一 মেয়েটা হি-হি ক’রে হাসচে এবং কৌতুকের সঙ্গে রাস্তা থেকে ধুলোবালি খোয়া কুড়িয়ে ছুডে ছুড়ে মাকে মারছে। আমি মেয়েটাকে একটা কড়া ধমক দিয়ে বললাম-ফের মাকে যদি অমন করবি, তবে পুলিসে ধরিয়ে দেবো। পকেটে হাত দিয়ে দেখি, আনা সাতেক পয়সা আছে-সেগুলো সব তার ময়লা নেকৃড়াখানায় রেখে দিয়ে বললুম-তুমি কেঁদো না বাছা-আমি কাল এসে তোমায় আরও পয়সা দেবো । তোমার মেয়ে আর মারবে না । যদি মাৱে তো বলে দিও, কাল আমি দেখে নেবে এমন ছন্নছাড করুণ দুরবস্থার রূপ জীবনে কোনদিন দেখিনি। পরদিন হাওড়া-পুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন বা আর কোনদিন সেই অন্ধ ভিখারিণীর দেখা পাইনি। তাকে কত খুজেছি, ভগবান জানেন। প্রতিদিন শোবার আগে তার কথা আমার মনে হয়। মনে মনে বলি, আটঘরার বটতলায় তোমায় প্রথম দেখেছিলুম ঠাকুর, তোমার মুখে অত করুণা মাখানো, মানুষকে এত কষ্ট দাও কেন ? তা হবে না, তার ভাল করতেই হবে তোমায়, তোমার আশীৰ্বাদের পুণ্যধারায় তার সকল দুঃখ ধুয়ে ফেলতে হবে তোমাকে।