বলিতে লাগিল, যে স্ত্রী অনাত্মীয় অপরিচিতপ্রায় পুরুষের কৃপাভিক্ষা করিয়া পত্রদ্বারা আহ্বান করিবার সঙ্কোচ অনুভব করে না, এবং সেকথা নির্লজ্জ দাম্ভিকার ন্যায় পথে-ঘাটে প্রচার করিয়া বেড়ায়, তাহাকে আর যাহাই হোক সম্মানের উচ্চ আসনে বসানো চলে না। কিন্তু অকস্মাৎ কিন্তু তাহার এইখানে বাধা পাইয়া থামিল। পত্রবহুল মনসাগাছের বাঁক ফিরিতেই তাহার উৎসুক দৃষ্টি সন্নিকটবর্তিনী ষোড়শীর আনত মুখের উপর গিয়া পড়িল। সে প্রাঙ্গণের বাহিরে দাঁড়াইয়া একমনে বেড়ার দড়ি বাঁধিতেছিল, আগন্তুকের পদশব্দ শুনিতে পাইল না, এবং ক্ষণকালের জন্য নির্মল না পারিল নড়িতে, না পারিল চোখ ফিরাইতে। এই ত সেদিন, তবুও তাহার মনে হইল এ সে ভৈরবী নয়। অথচ পরিবর্তন যে কোন্খানে তাহাও ধরিতে পারিল না! সেই রাঙাপাড়ের গৈরিক শাড়ি-পরা, তেমনি রুক্ষ এলোচুল, গলায় তেমনি রুদ্রাক্ষের মালা, তেমনি মুখের উপরে উপবাসের একটি শীর্ণ ছায়া―সিঁদুর মাখানো ত্রিশূলটি পর্যন্ত তেমনি হাতের কাছে ঠেস দিয়ে রাখা―কিছু বদলায় নাই, তবুও অপরিচিত, অজানা মোহে তাহাকে মুহূর্ত কয়েকের নিমিত্ত স্তম্ভিত করিয়া দিল। দড়ির গ্রন্থি টানিয়া দিয়া ষোড়শী মুখ তুলিয়াই একটু চমকিত হইল, কিন্তু পরক্ষণেই দড়ি ছাড়িয়া দিয়া স্নিগ্ধমধুর হাসিয়া সুমুখে আসিয়া কহিল, আসুন, আমার ঘরে আসুন।
নির্মল অপ্রস্তুত হইয়া বলিল, কিন্তু আপনার কাজে যে বাধা দিলাম।
ষোড়শী সকৌতুকে মুচকিয়া হাসিয়া কহিল, বেড়া-বাঁধা বুঝি আমার কাজ? আর হলোই বা কাজ, কুটুম্বকে খাতির করাটা বুঝি কাজ নয়? শ্বশুরবাড়িতে জামাইয়ের আদর হয়নি, কিন্তু শালীর কুঁড়েঘর থেকে ভগিনীপতিকে অনাদরে ফিরতে দেব না। আসুন, ঘরে গিয়ে বসবেন চলুন। খোকা, হৈম, চাকর-বাকর সব ভাল আছে? আপনি নিজে ভাল আছেন?
নির্মল কেমন যেন সংকুচিত হইয়া পড়িল। ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সবাই ভাল আছে, কিন্তু আজ আর বসব না।
ষোড়শী কহিল, কেন শুনি? তারপরে কণ্ঠস্বর নত করিয়া আরও একটু কাছে আসিয়া বলিল, একদিন হাত ধরে অন্ধকারে পার করে এনেছিলাম মনে পড়ে? দিনেরবেলায় ওতে আর কাজ নেই, কিন্তু চলুন বলচি। যে এতদূর থেকে টেনে আনতে পারে, সে এটুকুও টেনে নিয়ে যেতে পারবে।
নির্মল লজ্জাবোধ করিল, আঘাত পাইল। এই আচরণ, এই কথা ষোড়শীর মুখে কেবল অপ্রত্যাশিত নয়, অচিন্ত্যনীয়। বিদুষী সন্ন্যাসিনী ভৈরবীকে সে শান্তসমাহিত দৃঢ়, এমনকি কঠোর বলিয়া জানিত। সংসারে রমণীর পর্যায়ভুক্ত করিয়া কল্পনা করিতে যেন তাহার বাধিত। তাহাকে অনেক ভাবিয়াছে―কর্মের মধ্যে বিশ্রামের মধ্যে এই ষোড়শীকে সে চিন্তা করিয়াছে―সমস্ত অন্তর রসে ভরিয়া উঠিয়াছে, কিন্তু কখনও চিন্তাকে সে পদ্ধতি দিবার, শঙ্খলিত করিবার সাহস পর্যন্ত করে নাই। কিন্তু সেই ষোড়শী আজ যখন অপ্রত্যাশিত আত্মীয়তার অতি-ঘনিষ্ঠতায় অকস্মাৎ নিজেকে ছোট করিয়া, মানবী করিয়া, সাধারণ মানবের কামনার আয়ত্তাধীন করিয়া দিল, নির্মল
১১৯